রাস্তা সংস্কার করলেন গ্রামবাসী, টাকা তুললেন চেয়ারম্যান!

সোহেল তালুকদার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ


জুন ১২, ২০২১
১০:২৪ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১২, ২০২১
১০:২৪ অপরাহ্ন



রাস্তা সংস্কার করলেন গ্রামবাসী, টাকা তুললেন চেয়ারম্যান!

সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনির উদ্দিনের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়, গ্রামবাসীর টাকায় করা রাস্তার কাজ দেখিয়ে সরকারি প্রকল্পের ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন মো. মনির উদ্দিন। গত বুধবার প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন সিদখাই গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে মনু মিয়া। 

লিখিত অভিযোগে জানা যায়, সিদখাই গ্রামের জনসাধারণ গ্রামের আয় ও মসজিদের ফান্ডের টাকা দিয়ে সিদখাই জামে মসজিদ থেকে শফিকুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ মিটার রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেন গ্রামবাসী। অন্যদিকে গ্রামের মনু মিয়ার বাড়ি থেকে সিদখাই জামে মসজিদের সামনে পর্যন্ত প্রায় ১০০ মিটার মাটির রাস্তা নির্মাণ করেন গ্রামের মনু মিয়া। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন গ্রামের এই সমস্ত কাজ দেখিয়ে সরকারি প্রকল্পের ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। 

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) সাধারণ কর্মসূচির আওতায় উপজেলাওয়ারী ১ম পর্যায় নন-সোলার প্রকল্পের মাধ্যমে দরগাপাশা ইউনিয়নের '৫ নম্বর ওয়ার্ডের সিদখাই গ্রামের মনু মিয়ার বাড়ি থেকে স্কুলের রাস্তা পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট' নামে একটি প্রকল্প দেওয়া হয়। এই প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিদখাই গ্রামের প্রধান রাস্তা শফিকুল ইসলামের বাড়ি থেকে সিদখাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে সিদখাই জামে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ মিটার রাস্তায় মাটি ভরাট করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মসজিদের দক্ষিণ পাশ থেকে গ্রামের প্রধান রাস্তা থেকে মনু মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত আরও ১০০ মিটার রাস্তা মাটি দিয়ে ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে।

দরগাপাশা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সিদখাই গ্রামের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম বলেন, গ্রামের প্রধান রাস্তাটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বেহাল ছিল। আমাদের ছেলে-মেয়েরা বর্ষাকালে স্কুলে যেতে পারে না, আমরা মসজিদে ও বাজারে যাতায়াত করতে পারি না। আমাদের গ্রামের লোকজন যাতায়াতে চরম দুর্ভোগে ছিলেন। গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেই আমরা আর অপেক্ষা করব না। এবার গ্রামের রাস্তাটি আমাদের নিজেদের টাকায় সম্পন্ন করব। আর সে লক্ষ্যেই আমরা গ্রামবাসী মিলে সকল পরিবারে গিয়ে নির্ধারিত হারে চাঁদা নিয়ে টাকা সংগ্রহ করি। সেই সঙ্গে গ্রামের একমাত্র মসজিদের ফান্ড থেকেও টাকা সংগ্রহ করে শফিকুল ইসলামের বাড়ির সামনে থেকে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ মিটার রাস্তায় মাটি ভরাট করেছি। সম্পূর্ণ নিজেদের টাকায় আমরা এই রাস্তা নির্মাণ করেছি। 

সিদখাই জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লী কদ্দুস আলী বলেন, রাস্তায় সরকারি বরাদ্দ না পেয়ে আমরা গ্রামবাসী মিলে চাঁদা তোলে ও মসজিদ ফান্ডের টাকা দিয়ে মাটি ভরাট করেছি। গ্রামের প্রধান রাস্তা আমরা সবাই মিলে নিজেদের টাকায় নির্মাণ করলেও মনু মিয়ার বাড়ি থেকে মসজিদ পর্যন্ত প্রায় ১০০ মিটার রাস্তায় মাটি ভরাট করেছেন মনু মিয়া। এখানেও কোনো সরকারি টাকা দেওয়া হয়নি বলে জানতাম। এখন শুনতে পাচ্ছি মনু মিয়ার বাড়ি থেকে স্কুলের রাস্তা পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট বাবদ সরকারি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন। আমরা গ্রামবাসী ও মনু মিয়া সরকারি বরাদ্দের কোনো টাকা পাইনি। 

গ্রামের আফজাল মিয়া, মধু মিয়া, মজমিল হক, আনোয়ার আলী, আলতাব আলী, আব্দুল আলী, আসাদ আলী, তোরাব আলীসহ অনেকেই জানান, সরকারি কোনো টাকা গ্রামবাসী পাননি। তারা তাদের নিজেদের টাকায় প্রধান রাস্তাটি নির্মাণ করেছেন। মনু মিয়ার রাস্তাটিও মনু মিয়া নিজের টাকা দিয়ে নির্মাণ করেছেন। তবে মনু মিয়ার রাস্তায় ইউপি চেয়ারম্যান বলেছিলেন সরকারি বরাদ্দ দিবেন আর এটা বলেই তিনি মনু মিয়াকে দিয়ে মনু মিয়ার নিজস্ব টাকায় এই রাস্তা বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু চেয়ারম্যান মনু মিয়াকে কোনো টাকা দেননি। এখন দেখা যাচ্ছে, এই রাস্তায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ এসেছিল। প্রকল্পের টাকা উত্তোলনও করা হয়েছে। পরে জানা গেছে, চেয়ারম্যান নিজেই এই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গ্রামের কাউকে তিনি কোনো টাকা দেননি।

অভিযোগকারী মনু মিয়া বলেন, আমার বাড়ির দক্ষিণ পাশের প্রায় ৫০টি পরিবার আছে এবং হাটি বাড়ী হিসেবে লোকজন বর্ষা মৌসুমে আমার বাড়ির উপর দিয়ে মসজিদের পাশ হয়ে গ্রামের প্রধান রাস্তায় চলাচল করে থাকে। চেয়ারম্যান সাহেবকে বলেছিলাম রাস্তাটি করে দেওয়ার জন্য। তখন তিনি আশ্বস্ত করে  বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার কাছ থেকে কাজ করিয়ে ফেল, জুন-জুলাইয়ে সরকারি বরাদ্দ এলে তোমাকে ২ লাখ টাকা দিয়ে দেব। আমি সেই অনুমানে ধার-দেনা এবং গ্রামের আরও লোকজনের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকার কাজ করিয়েছি। কাজ করার পর একাধিকবার যোগাযোগ করি। পরে আমি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমার এই প্রকল্পের ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার পুরোটাই চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য মিলে আত্মসাৎ করেছেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য সমুজ আলী বলেন, এই প্রকল্পের পিআইসি কমিটির সভাপতি আমি। আমি নিজেই মনু মিয়াকে ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকা দিয়েছি। 

কোনো ডকুমেন্ট আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা দেওয়ার কোনো ডকুমেন্ট নাই। তবে পিআইসি কমিটির সভাপতি আমি থাকলেও কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন মনু মিয়া নিজেই। 

আর দরগাপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মনির উদ্দিন টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, মনু মিয়া রাস্তার জন্য আমার কাছে দাবি করেছিলেন। টাকাটা ইউপি সদস্যের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার উজ জামান বলেন, এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। একটি কমিটি গঠন করে তাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছি। অভিযোগের সত্যতা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এসটি/আরআর-০৫