'ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও'

সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ


জুন ১২, ২০২১
১০:৩৪ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১২, ২০২১
১০:৩৪ অপরাহ্ন



'ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নাও'

দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা এখন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর। এই তাহিরপুরে রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর, শহীদ সিরাজ লেক (বাংলার কাশমির, সুইজারল্যান্ড ও নিলাদ্রী নামেও পরিচিত), স্বচ্ছ নদী জাদুকাটার তীরে বড়গোপ টিলা। এ টিলাটি বারেকের টিলা নামে পরিচিত। রয়েছে লাকমা ছড়া, চাঁনপুর ঝর্ণা, শিমুল বাগান, শাহ্ আরেফীনের মাজার, অদ্বৈত মহাপ্রভুর মন্দির ও হলহলিয়ার রাজবাড়ি। আপনি চাইলে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নৌকায় করে এই এলাকাগুলো ঘুরতে পারেন। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের কথার মতো ঝিলমিল করা আলোয় রাঙানো ময়ূরপঙ্খী নৌকা না থাকলেও এখানে রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বাহারি সব নৌকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্ষাকাল টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘোরার উপযুক্ত সময়। কারণ টাঙ্গুয়া থেকে নৌকায় করে সব পর্যটন এলাকায় সহজেই যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে একটি ভালো নৌকা ভাড়া নিতে হবে। নৌকার চালকরা স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ায় হাওরের প্রতিটি গ্রামের লোকজন তাদের পরিচিত। আর হাওরপাড়ের গ্রামের বাসিন্দারা সহজ, সরল ও অতিথিপরায়ণ। তবে তাদের আত্মসম্মানবোধ আর ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রবল। পর্যটকদের সুবিধার্থে এসব এলাকায় নানা ধরনের কাজে স্থানীয়রা সম্পৃক্ত আছেন।

হাওরে ঘুরে বেড়ানো ও রাত্রিযাপনের একমাত্র ব্যবস্থা নৌযান হওয়ায় অনেক বাহারি ও বিলাসবহুল নৌযানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাহিরপুর উপজেলায়। বিলাসবহুল অন্তত ২০টি নৌযান পর্যটকদের ভ্রমণকে নিরাপদ ও আনন্দময় করতে ভাড়ায় চলে। এছাড়াও ছোট-বড় আরও শতাধিক নৌযান রয়েছে, যেগুলো পর্যটকদের নিয়ে হাওরে ভাড়ায় চলে। স্টিল দ্বারা নির্মিত ৬টি নৌযান তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরতে যায় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এ সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে। কয়েকটি নৌকায় পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা ও যোগাযোগের মোবাইল নম্বর নিচে দেওয়া হলো।

আবিদা অ্যান্ড তাহা টাঙ্গুয়া প্রমোদতরী : এ নৌযানটি ২০১৭ সালে তৈরি করেন তাহিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের রতনশ্রী গ্রামের আতাউর রহমান তালুকদার। হাওর দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য এটিই প্রথম বিলাসবহুল নৌযান। এতে করে দিনের বেলায় দেড় থেকে দুই শতাধিক পর্যটক ঘুরে বেড়াতে পারেন। তবে রাত্রিযাপনের জন্য ২২ জন পর্যটকের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্য ব্যবস্থা রয়েছে। এতে আলাদা কেবিন আছে, যেখানে ২টি খাট রয়েছে। আছে বালিশ, লেপ, তোষক ও মশারির ব্যবস্থা। নৌযানটিতে তিনটি টয়লেট রয়েছে। এর মধ্যে একটি হাই কমোড আর দুইটি ফ্ল্যাট কমোড টয়লেট। ফ্ল্যাট কমোডের একটি নৌকার স্টাফদের জন্য। নিজস্ব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য আলাদাভাবে বেসিন দেওয়া আছে। বেসিন ও টয়লেটে পানি সরবহরাহের জন্য তিনশ লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার ট্যাংকি রয়েছে নৌযানটিতে। নৌযানের নিজস্ব মোটরে এই রিজার্ভ ট্যাংকিতে পানি উঠানো হয়।

সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবাহের জন্য আইপিস এর ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাধ্যমে ল্যাপটপ, মোবাইল সবই চার্জ দেওয়া যায়। আর আলোর ব্যবস্থা তো আছেই। আইপিএস নৌকার ইঞ্জিন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হয়ে থাকে। ইঞ্জিনের শব্দ দূষণ ঠেকাতে থাই গ্লাস ব্যবহার করা হয়েছে। শক্তিশালী ইঞ্জিনে চলা নৌযানটিতে অটো গিয়ারে রয়েছে। নৌযানটির ছাদে এক সঙ্গে দেড় শতাধিক লোক নিয়ে যে কোনো অনুষ্ঠান পরিচালনা করা যায়। পর্যটকদের সুবিধার জন্য পাচক ও রান্নার সুব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে স্থানীয় শিল্পীগোষ্ঠী দিয়ে গানের জলসা আয়োজন করা যায় নৌকার ছাদে। এই নৌযানটি দিয়ে মোবাইল ফোন কোম্পানি বাংলালিংক ও ব্রিটিশ টোবাকো হাওরে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছে ২০১৮ সালে। প্রতিটি নৌকাতেই হাই কমোড, লো কমোড, লেপ, তোষক, বালিশ ও মশারি রয়েছে। রয়েছে টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে খাওয়া, গানের আয়োজন ও লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা।

এই নৌযানটি একদিনের জন্য ভাড়া নিলে ১২ হাজার টাকা লাগবে। দুই দিন ও এক রাতের নিলে ১৮ হাজার টাকা লাগবে। সাধারণত তাহিরপুর উপজেলা সদরের বাজার ঘাট বা থানা ঘাট থেকে যাত্রা শুরু হয় প্রথম দিন। টাঙ্গুয়ার হাওর, পর্যটক টাওয়ারসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে নৌকায় রাত্রিযাপন করা যায় ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প ঘাটে। এখান থেকেই শহীদ সিরাজ লেক ও লাকমা ছড়া হেঁটেই স্বাচ্ছন্দ্যে দেখা যায়। তবে চাঁনপুর ঝর্ণা, বড়গোপ টিলা, যাদুকাটা নদী ও শিমুল বাগান যেতে হলে মোটরবাইক বা অটোতে করে যেতে হবে। রান্না ও গানের জন্য আলাদা অর্থ খরচ করতে হবে। আবিদা অ্যান্ড তাহা টাঙ্গুয়া প্রমোদতরী ভাড়ার জন্য যোগাযোগ করা যাবে ০১৭৩৩১৭২৪৫৮ নম্বরে।

সিন্দাবাদ তরী : এই নৌযানটিও আকর্ষণীয়। এতে জেনারেটরের সুবিধা রয়েছে। ফ্যান চলে ৬টি। এক সঙ্গে ২০টি মোবাইল চার্জ দেওয়া যায়। বৃষ্টি বা যে কোনো দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ২৪ জন পর্যটকের রাত্রিযাপনের সুবিধা আছে। স্বাচ্ছন্দ্যে ১৮ জন রাত্রিযাপন করতে পারেন। রয়েছে বেসিন, ১টি হাই কমোড ও ২টি লো কমোডের টয়লেট। দুই রাত ও এক দিনের জন্য নৌকাটি ভাড়া নিলে ২৪ হাজার টাকা লাগবে। এই প্যাকেজটি নিলে পর্যটকদের খাবার ও বাবুর্চির জন্য আলাদা কোনো টাকা দিতে হবে না। তবে একদিনের জন্য লাগবে ১৭ হাজার টাকা। যোগাযোগ করতে হবে ০১৬৭৩ ১১১২৩৭ (এমরান) নম্বরে।

টাঙ্গুয়া নৌ পরিবহন : এই নৌযানটিতেও একই ধরনের সুবিধা রয়েছে। রাতের বেলা ২৪ জন পর্যটকের থাকার সুব্যবস্থা আছে। দুই দিন ও এক রাতের জন্য ভাড়া পড়বে ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা। আর একদিনের জন্য ভাড়া ৬ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা। যোগাযোগ করা যাবে ০১৭১২১৪৩৭৫৩ (সামায়ূন কবীর) নম্বরে ।

মোহনা নৌ পরিবহন : এটিতেও একই সুবিধা রয়েছে। তবে ফ্যান আছে ৩টি। চলে আইপিএস-এ। বেসিন, হাই কমোড, লো কমোড সুবিধা প্রতিটি নৌকার মতো এখানেও আছে। দিনের বেলা এটিতে ১০০ জন পর্যটক ঘুরতে পারেন। তবে স্বাচ্ছন্দ্যে ২০-২৫ জন রাত্রিযাপন করতে পারেন। ভাড়া পড়বে দুই দিন ও এক রাতের জন্য ২০ হাজার টাকা। আর একদিনের জন্য ভাড়া পড়বে ১০ হাজার টাকা। যোগাযোগ করা যাবে ০১৭১৪৩৬৫০১২ (আলম) নম্বরে।

মুক্তা মণি নৌ পরিবহন : একই ধরনের সুবিধা থাকলেও এই নৌকায় নেই হাই কমোড, নেই মোবাইল চার্জের ব্যবস্থা। গ্যাস বিল ও বাবুর্চির খরচ নৌকার কর্তৃপক্ষ বহন করবে। এই নৌকায় রাতের বেলা ১২ জন পর্যটক থাকতে পারেন। দুই দিন ও এক রাতের ভাড়া পড়বে ১২ হাজার টাকা। আর এক দিনের জন্য ভাড়া নেওয়া যাবে ৫ হাজার টাকায়। যোগাযোগ করতে হবে ০১৭১৮১৬৮৩১৪ (পরাণ আখঞ্জি) নম্বরে।

যেভাবে যাবেন : ঢাকার সায়দাবাদ, ফকিরাপুল বা অন্য কোনো বাসস্টেশন থেকে প্রতিদিন শ্যামলী ও মামুন পরিবহন এবং মহাখালী থেকে এনা পরিবহনের বেশ কয়েকটি ডে-নাইট বাস সরাসরি সুনামগঞ্জে যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৫৫০ থেকে ৭৫০ (এসি বাস) টাকা। এখন করোনাকালী বাস ভাড়া অবশ্য একটু বেশি। দিনের বেলা ৬-৭ ঘণ্টার বাস ভ্রমণ করে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে এসে যে কোনো হোটেল, কটেজ বা সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের রেস্ট হাউসে রাত্রীযাপন করা যায়। আবার রাতের বাসে উঠলে ভোরে পুরাতন বাসস্টেশনের কোনো রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে আগে থেকে কথা বলে রাখা মাইক্রোবাস, কার বা পুরাতন বাসস্টেশন থেকে আব্দুজ জহুর সেতু পর্যন্ত রিকশায় গিয়ে অন্য কোনো যানবাহনে (অটোরিকশা বা মোটরসাইকেল) তাহিরপুরে যেতে পারেন। 

ভ্রমণ পরিকল্পনা : যদি টাঙ্গুয়ার হাওরে দুইদিনের ভ্রমণসূচি গ্রহণ করা যায়, তাহলে হাওরকে ভালো করে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে রাত্রিযাপন করতে হবে হাওরের ভেতরে বা পাশের কোনো গ্রামে। যদি হাওরের ভেতরে থাকতে চান, তবে নৌকায় থাকা সবচেয়ে রোমাঞ্চকর। রান্নার জন্য ট্যুর গাইডের সাহায্য নিতে পারেন। হাওড়ের টাটকা মাছ অথবা হাঁসের ডিম এখানে সহজেই পাওয়া যায়। মোরগ বা সবজি কিনতে পারবেন। হাঁড়ি-পাতিল তাহিরপুর বাজারের যে কোনো ডেকোরেটর্স থেকে ভাড়ায় নিয়ে আসতে পারেন। তবে নৌকায় যারা থাকবেন, তারাই এগুলো ব্যবস্থা করবেন।

আপনি প্রথমে তাহিরপুর বাজার থেকে নৌকায় করে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসবেন। সেখানে ওয়াচ টাওয়ারের কাছে সময় কাটাতে পারেন। এখানে স্বচ্ছ নদীতে গোসল করতে পারবেন। এ জায়গা থেকে ট্যাকেরঘাটে আসতে পারেন। এখানে শহীদ সিরাজ লেকসহ আশপাশের এলাকা ঘুরতে পারেন। এখান থেকে চাইলে মোটরসাইকেলে করে বড়গোপ টিলায় (বারেকের টিলা) আসতে পারেন। টিলার নিচেই রয়েছে জাদুকাটা নদী। পাশেই রয়েছে শিমুল বাগান। আপনি মোটরসাইকেলে করে বড়গোপ টিলায় না আসতে চাইলে সরাসরি নৌকা নিয়েও আসতে পারেন। এক্ষেত্রে নৌকার মালিককে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হতে পারে। রাতে সুবিধামতো জায়গায় থাকবেন। তবে সবচেয়ে ভালো হয় টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় থাকলে। ভ্রমণ শেষ করে সন্ধ্যায় তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জ ফিরতে পারবেন। পরে রাতের বাসে ফিরে যাবেন ঢাকায়।


এএম/আরআর-০৬