সুনামগঞ্জ হাসপাতালে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি, সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা

সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ


জুন ১৫, ২০২১
১০:১৬ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১৫, ২০২১
১০:১৬ অপরাহ্ন



সুনামগঞ্জ হাসপাতালে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি, সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা

সুনামগঞ্জ জেলার সাধারণ মানুষের একমাত্র উন্নত চিকিৎসার আশ্রয়স্থল সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল। ছোট-খাটো বা বড় কোনো শারীরিক সমস্যার নিরাময় ও ভরসার জায়গা এটিই। তবে হাসপাতালের ভেতরে অব্যবস্থাপনার চিত্র ভয়াবহ। কর্তৃপক্ষ বলছেন, জনবল কম হওয়ায় চাইলেও তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে পারছেন না।

সকাল ১০টা থেকে হাসপাতালের প্রবেশপথে দেখা গেছে বেশিরভাগ মানুষকে মাস্ক ছাড়া ভেতরে ঢুকতে। অনেকের আবার মুখের থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখা ছিল মাস্ক। নেই কোনো শারীরিক দূরত্ব। তারা বেশিরভাগই রোগীর আত্মীয়-স্বজন। অনেকে এসেছেন দলবল সঙ্গে নিয়ে। এসব আত্মীয়-স্বজনদের হাসপাতালের ভেতর সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে চলাফেরা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

হাসপাতালের ডিসপেনসারির সামনেও একই অবস্থা দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো উদ্যোগ নেই সেখানে। ৫ টাকা ফি দিয়ে টোকেন পেতে যেমন রয়েছে দীর্ঘ সারি, ডাক্তার দেখাতেও তেমন একই অবস্থা। অপেক্ষা ছাড়া এখান থেকে মুক্তি মিলছে না কারও। ডাক্তার দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র মিললেও ডিসপেনসারিতে ওষুধ পেতে আবারও দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। কয়েক ঘণ্টার দীর্ঘ এ প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যবিধি না মানায় মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। 

আট তলা বিশিষ্ট হাসপাতালের উপরে উঠতে রয়েছে দু'টি লিফট। অনেকে পায়ে হেঁটে উপরের তলায় উঠলেও বেশিরভাগ রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজন ঠেলাঠেলি করে এ দু'টি লিফট ব্যবহার করছেন। পরিশ্রম কমানোর জন্য লিফটে উঠলেও জেনে-শোনে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছেন তারা।

হাসপাতালের ৪ তলায় দেখা গেল ভিন্ন এক চিত্র। দুইপাশের ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট ডাক্তার ভর্তিরত রোগীদের দেখছিলেন। এ সময় রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের ওয়ার্ডের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। চারতলার দুই কেবিনের মাঝের ফাঁকা জায়গায় এসে অবস্থান নেন ভর্তিরত রোগীদের আত্মীয়-স্বজন। তাদের পরস্পরের মাঝে শারীরিক দূরত্ব ও সখ্যতা দেখে বোঝার উপায় নেই মহামারি করোনা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে সময় পার করছি আমরা।

ডাক্তারের ওয়ার্ড পরিদর্শন শেষে ৫ তলায় পুরুষ সার্জারির ৫০২ নম্বর ওয়ার্ডের ভেতরকার অবস্থা আরও ভয়াবহ দেখে গেছে। ওয়ার্ডের বাইরে থেকে অতিরিক্ত মানুষের জন্য সিটে ভর্তি রোগীকে দেখা যাচ্ছিল না। ভেতরে ঢুকতেই স্পষ্ট দেখা মিলে অতিরিক্ত চার থেকে পাঁচজন করে রোগীর স্বজনের। তাদের কারও মুখেই নেই মাস্ক। যাদের রয়েছে তাও থুতনির নিচে পড়া। এতে করে ডাক্তার ও নার্সদের দেখে নাক-মুখ ঢাকলেও করোনা থেকে বাঁচা সম্ভব নয় বলে জানালেন নিজেরাই। 

পৌর শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জলিলপুর গ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক। তার স্ত্রীর শরীর ব্যথা হওয়ায় তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন ৪ দিন আগে। আর যাওয়া হয়নি। সকাল ১১টায় নিচতলায় দেখা তার সঙ্গে। মুখে মাস্ক নেই কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ওয়ার্ডে মাস্ক রেখে এসেছেন তিনি। ডাক্তার আসবে তাই ওয়ার্ডের নার্সরা তাড়াহুড়ো করে বের করে দেন তাকে। তাই মাস্ক ফেলে এসেছেন ওয়ার্ডে।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ডুংরিয়া গ্রামের বাসিন্দা হারুন মিয়া। বয়সের ছাপ তার মুখে ও শরীরে বহন করে হাঁটছিলেন হাসপাতালের বারান্দায়। জানালেন, ভাতিজা সুফিয়ানকে নিয়ে গতরাতে হাসপাতালে এসেছেন। এখন সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আলাপচারিতার সময় মাস্কের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বাইরে থেকে আনবেন বলে বেরিয়ে যান। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে মাস্কসহ দেখা গেছে তাকে।

হালুয়ারঘাটের বাসিন্দা মিনারা বেগম জানান, তার মাস্ক বাড়িতে ভুলে ফেলে এসেছেন। বাড়িতে নিয়মিত মাস্ক পড়তে হয় না। তাই এমন ভুল হয় মাঝে মাঝে।

সুনামগঞ্জের সচেতন মহলের দাবি, করোনা মহামারি সারা দেশে যেভাবে বিস্তার করেছে, তা প্রতিরোধ করার জন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া দেশের মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে সুনামগঞ্জের প্রথম একজন শনাক্ত হয়েছেন। মানুষের যেকোনো অসুস্থতার জন্য সর্বপ্রথম সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে যেতে হয়। করোনা নেগেটিভ/পজেটিভ পরে জানা যায়। এর আগে কিন্তু হাসপাতালে যায় সবাই। তাই সবাই যদি স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলে, তাহলে হাসপাতাল হবে করোনার সংক্রমিত হওয়ার জায়গা। 

সুনামগঞ্জ জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অ্যাডভোকেট আইনুল ইসলাম বাবলু বলেন, সবাই মাস্ক পরা প্রয়োজন। কারণ সীমান্ত জেলাগুলোতে যেরকম করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, নিজ থেকে সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে দর্শনার্থীদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও আরও সচেতন হতে হবে।

সুনামগঞ্জ পৌর কলেজের সাবেক অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, সুনামগঞ্জ সীমান্ত জেলা। এখানে এত উদাসীন হলে হবে না। সদর হাসপাতালে রোগী কারা আর আত্মীয়-স্বজন চেনা যায় না। রোগীর সঙ্গে চার/পাঁচজন করে থাকেন। কারও মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। এজন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা রয়েছে। সাধারণ মানুষ যদি তাদের কথা না শোনে, তারা পুলিশের সহায়তা নেবেন। এসব কিছু না করে আমাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তারা। কারণ সব ধরনের রোগী এখানে আসে। কর্তৃপক্ষ যদি স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে একজন ভালো মানুষ সংক্রমিত হয়ে বাড়ি যাবে। 

সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনিছুর রহমান বলেন, হাসপাতালের ভেতরে রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজনরা মাস্ক পরেন না। এছাড়াও তিন/চারজন জমায়েত হয়ে গল্প করেন। এতে করোনার বিস্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সবার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা জন্য। আমরা যখন রাউন্ডে যাই, তখন সবাইকে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। দেখা গেল ৪ তলায় গেলে স্বজনরা ৫ তলায় আশ্রয় নেয় আর ৫ তলায় গেলে ৪ তলায় আশ্রয় নেয়। 

জনবল সংকটের কারণে সবকিছু চাইলেও সুন্দরভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক আসবে বলেছিল। তাদের জন্য আমরা পরিচয়পত্র বানিয়ে রেখেছিলাম। পরে তারা আসেনি। তবে খুব তাড়াতাড়ি বাইরে কলাপসিবল গেট নির্মাণ করে দর্শনার্থী ও রোগীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।


এএম/আরআর-০১