সোহেল তালুকদার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ
জুন ১৮, ২০২১
১০:০৯ অপরাহ্ন
আপডেট : জুন ১৮, ২০২১
১০:১৬ অপরাহ্ন
সারাদিন কায়িক পরিশ্রম শেষে এখন আর ফুটপাত বা অন্যের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় খুঁজতে হবে না ভূমিহীন ও গৃহহীন হতদরিদ্র আয়বানু বিবি ও আমিরুন নেছাকে। ঝড় তাদের তাড়া করবে না, ভিজতে হবে না বৃষ্টিতে। এখন প্রতিদিন ফিরতে পারবেন নিজের পাকা ঘরে। শুধু ঘরই নয়, থাকছে নিজ নামে দুই শতক জমি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, সুন্দর বারান্দাসহ বসবাসের নিরাপদ সুবিধা। আয়বানু বিবি ও আমিরুন নেছার মতো সুনামগঞ্জের ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলো পেতে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া স্বপ্নের বাড়ি।
সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১১টি উপজেলায় ১ম পর্যায়ে ৩ হাজার ৯০৮টি ও ২য় পর্যায়ে ৩৫৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার পাচ্ছে ‘স্বপ্নের নীড়’। এর মধ্যে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ২য় পর্যায়ে ৩৫৮টির মধ্যে ২০৯টি ঘর হস্তান্তর করা হবে। ১ম ও ২য় পর্যায়ে গৃহহীনদের মধ্যে দুই শতক জমিসহ গৃহ হস্তান্তর করা হবে।
এর মধ্যে জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ১ম পর্যায়ে ১৫১টি ও ১০০টি এবং ২য় পর্যায়ে ১০টিসহ মোট ২৬১টি ঘর পাচ্ছেন গৃহহীন ও ভূমিহীনরা। আগামী রবিবার সকালে গণভবন থেকে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবারগুলোর মধ্যে এসব বাড়ি হস্তাস্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর বিনামূল্যে ঘর উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জ জেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর মধ্যে নতুন ঘর উপহার দেওয়া হচ্ছে। ১মম ও ২য় পর্যায়ে জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২৬১টি পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে নতুন এসব বাড়ি। নতুন ঘর পাওয়া এসব ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষগুলোর চোখে-মুখে এখন অনাবিল স্বপ্ন।
বাড়ি পাওয়ার আনন্দে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের নোয়াগাঁও এলাকার ভূমিহীন মৃত আব্দুল আহাদের স্ত্রী আয়বানু বিবি ও মৎস্যজীবী শামছুন নুরের স্ত্রী আমিরুন নেছার চোখে ডেকেছে আনন্দাশ্রুর বান। ঘর পেয়ে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করায় আয়বানু বিবি বলেন, আমি ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে মানুষের জায়গায় কুঁড়ে ঘর তুলে থাকি। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি আমি জমিসহ ইটের একটি নতুন ঘর পাব, শেখ হাসিনার সরকার আমাকে ইটের ঘর দেবেন, এই বয়সে ইটের পাকা দালানঘরে থাকতে পারব। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি ঘর পেয়ে। দোয়া করি শেখ মুজিবের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।
মৎস্যজীবী শামছুন নুরের স্ত্রী আমিরুন নেছা বলেন, ছোট ছোট ৭টি সন্তান নিয়ে খড়কুটোর ঘরে থাকতাম। বৃষ্টি এলেই অন্যের বাড়িতে ও বারান্দায় আশ্রয় নিতাম। অনেক কষ্টে জীবনযাপন করতে হতো। সরকার আজ আমাদের একটি সুন্দর ঘর দেওয়ায় আমরা এখন অনেক খুশি। জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি এভাবে একটি সুন্দর ঘর পাব।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শাহাদাৎ হোসেন ভুঁইয়া জানান, সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি ঘরের জন্য দুই শতাংশ খাস জমির বন্দোবস্তসহ দুই কক্ষের সেমিপাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘরের প্রতিটিতে একটি রান্নাঘর, টয়লেট ও সামনে খোলা বারান্দা রয়েছে। প্রতিটি ঘর ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করে ব্যয় ধরে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তিনি জানান, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জন্য সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে ‘ক’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত ভূমিহীন ও গৃহহীন ৪১১টি পরিবারের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ১ম ও ২য় পর্যায়ে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় ২৬১টি পরিবারকে জমি ও ঘর নির্মাণ করে দিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জয়কলস ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে ৬২টি, পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের ঘোড়াডুম্ভুর ও পিটাপসী গ্রামে ১৫১টি এবং পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের নবীনগর ও শত্রুমর্দন গ্রামে ৫১টি ঘর বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করে। তবে প্রথম পর্যায়ে নির্মিত ১০টি ঘরে সরকারি বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করে।
উপজেলার জয়কলস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাসুদ মিয়া বলেন, মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ঘরগুলোর উপকারভোগী বাছাই করতে অনেক শ্রম দিয়েছি। প্রকৃত ভূমিহীন বাছাই করে এই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এজন্য মননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ অঞ্চলের মানুষের পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার উজ জামান বলেন, ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য চমৎকার পরিবেশে মানসম্মত টেকসই ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘরে আশ্রয় পাওয়াদের অধিকাংশই রাস্তার ধারে ফুটপাত বা কারও আশ্রয়ে বসবাস করতেন। তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর উপহার পেলেন। এর ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার শতভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাদের জমি ও ঘর নেই, তাদের বসবাসের জন্য বাড়ি করে দেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সারা বাংলাদেশে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রায় ৫৩ হাজার ঘর নির্মাণ করেছে সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ২য় পর্যায়ে ২০৯টি ঘর পাচ্ছেন হাওর অঞ্চলের দরিদ্র ভূমিহীন ও গৃহহীনরা। এর আগেও এই জেলায় ১ম পর্যায়ে বিভিন্ন উপজেলায় ৩ হাজার ৯০৮টি ঘর বরাদ্দ হয়েছিল। সেগুলো হস্তান্তর করা হয়ে গেছে। পর্যায়ক্রমে জেলার প্রতিটি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ঘর দেওয়া হবে। এই কাজ চলমান আছে। দেশের কোনো অঞ্চলেই ভূমিহীন ও গৃহহীন কেউ থাকবে না। দরিদ্র মানুষগুলো ঘর পেয়ে অনেক আনন্দিত। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করছেন, সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করছেন।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সিলেট মিররকে বলেন, এই প্রকল্পটি আমাদের জন্য একটি গৌরবের ও আত্মমর্যাদার প্রকল্প। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের জন্যই এই ঘরগুলো বাস্তবায়ন করছেন। ঘরগুলো জায়গাসহ পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুইজনের নামে সাফ কবলা (দলিল) করে হস্তান্তর করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদের ক্ষতায়ন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমি মনে করি এই প্রকল্পটি আমাদের জন্য একটি আত্মমর্যাদার প্রকল্প।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের কোনো মানুষ আর গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না। আমাদের নেত্রী এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। আমরা সর্বাত্মক নেত্রীর সঙ্গে আছি। দেশের দরিদ্র মানুষগুলো ঘর পেয়ে কি যে আনন্দ প্রকাশ করছে তা আপনারা বা কেউ না দেখলে বুঝবেন না। একটু আশ্রয়ের আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে যখন মাথা গোঁজার ঠাই পায়নি, ঠিক সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশের ভূমিহীন-গৃহহীনদের মধ্যে একেবারে বিনামূল্যে ঘর নির্মাণ করে দেবেন। সেই সঙ্গে ২ শতক জায়গাও তাদের নামে দলিল করে দেবেন। আজ এই প্রকল্পটি সারা দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে। দেশের দরিদ্র মানুষগুলো আজ নিজের একটি ঠিকানা পাচ্ছে। এতে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমিও খুব গর্বিত।
এসটি/আরআর-০১