বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
জুন ২০, ২০২১
০৮:৩৮ অপরাহ্ন
আপডেট : জুন ২০, ২০২১
০৮:৩৮ অপরাহ্ন
স্বামী নেই ফুলরাজ বেগমের। ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ে রেখে ১০-১২ বছর আগে তার স্বামী মারা যান। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেদের মধ্যে ৩ জন আলাদা থাকেন। ছোট দুই ছেলেকে নিয়েই তার পরিবার। হেমন্তে গরুর পেছনে রাখালি করে যে আয় হয়, তা দিয়েই কোনোরককে দিনাতিপাত করছেন তিনি। যেখানে তিন বেলা পেট পুরে খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে ইট-কংক্রিটের বাসগৃহ তো কল্পনাতেও বেমানান। এজন্য খাস জায়গায় বাঁধা ছোট কুঁড়েঘরই ছিল তার শেষ ঠিকানা।
তবে এবার তার জীবনে ঘটেছে অভাবনীয় ঘটনা। অবশেষে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভূমি ও ঘর পেয়েছেন তিনি। শুধু ফুলরাজ বেগমই নন, স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকা তার দুই ছেলে রবিউল আউয়াল ও মঈনুল হকও সরকারি ঘর পেয়েছেন। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার ইউনিয়নের হরিহরপুর বাগহাঁটি গ্রামের আব্দুন নূরের স্ত্রী ফুলরাজ বেগমের মতো স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ এখন এ গ্রামের ৫০টি পরিবারে।
ফুলরাজের প্রতিবেশী ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমিনা বেগম একরাশ হাসি দিয়ে বলেন, এই জীবনে এরকম ঘরে থাকতে পারমু, এইডা স্বপ্নেও ভাবি নাই। হাসিনা এক্কেবারে ভালো কইরাই দিছে। ভাঙাচোরা ঘরে এতদিন কষ্ট কইরা দিন কাটাইছি। ছেলেমেয়েরে লইয়া এই পাকা ঘরে থাইক্যা এখন কি যে শান্তি পাইমু এর আনন্দ বুঝাইয়া কইতে পারতাম না। হাসিনা আমরারে ঘর দিছে আল্লাহ যেন তার মঙ্গল করেন।
জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের কাশিপুর গুচ্ছগ্রামের জুয়েল মিয়া নতুন ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, আমার কোনো বাড়ি-ঘর ছিল না। অন্যের ঘরে বসবাস করতে হতো আমাকে। অস্থায়ীভাবে জীবনধারণ করাটা সত্যিই কষ্টের। এই কষ্ট চিরতরে দূর করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তার দেওয়া পাকা ঘরে শান্তিতে থাকতে পারমু। দুই হাত তুলে দোয়া করি, আল্লাহ শেখ হাসিনারে বাঁচাইয়া রাখুক।
একই গ্রামের মো. সত্তার মিয়া ও তার স্ত্রী হাসিনা বেগম হাসিমুখে বলেন, খুব ভালো লাগতাছে, শান্তি লাগতাছে। আগে ভাঙ্গাচাঙ্গা ঘর ছিল। আর এখন ইট-পাথরের তৈয়ার ঘরে থাকমু। মেগের পানিতে আর ভিজন লাগত না। এইখানে যতজনরে ঘর দেওয়া হইছে সবাই এক্কেবারে গরিব। আমরা কখনও ভাবিনি এইরকম পাকা বিল্ডিং ঘরে থাকা হইব আমাদের। শেখ হাসিনা স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু দিছেন আমরারে। আল্লাহ তারে বড় আয়ু দেউক।
সদর ইউনিয়নের পশ্চিম লক্ষীপুর (উমেদপুর) গ্রামের শাহ আলম বলেন, আমরা দুই ভাইসহ আমার খালাতো ভাইও দুই শতাংশ জায়গাসহ ঘর পেয়েছে। এরকম অনেকেই পেয়েছে, যেটা কল্পনাতীত। কিন্তু আমরা সবাই যে ঘর পেয়েছি সেটা বাস্তব। সরকার আমরার মতো গরিব-দুঃখী মানুষের কথা বুঝতে পেরেছেন। এর জন্য সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই।
জামালগঞ্জে ৩০১টি পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্প। এর মাধ্যমে ভূমিহীন ও গৃহহীন এ সকল পরিবারের সহস্রাধিক মানুষ মাথা গোঁজার নিরাপদ ঠাঁই পেয়েছেন। কয়েকমাস আগেও যারা ভাঙাচোরা ঝুপড়ি ঘরে অগোছালো জীবনযাপন করে আসছিলেন, তারা আজ সরকারের দুর্যোগসহনীয় বাসগৃহ পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত। সরকারের ভূমিসহ গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের সহযোগিতায় পাল্টে গেছে প্রান্তিক পর্যায়ের খেটে খাওয়া দারিদ্রপীড়িত এসব মানুষের জীবনচিত্র। লাল সবুজের টিন আর ইট-কংক্রিটে আচ্ছাদিত হলুদাভ রঙে ছেয়ে গেছে উপজেলার ১৩টি গ্রাম। উপকারভোগী কয়েকটি গ্রাম ঘুরে বদলে যাওয়া জীবনযাপনের চালচিত্রই চোখে পড়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সুফলভোগী গ্রামগুলোতে পূর্বের জীর্ণদশা আর নেই। গত মাসছয়েক আগে যেখানে পুরোনো বাঁশ-টিনের বিবর্ণ দুইচালা ঘর কোনোরকমে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে ইট, বালু, পাথর, সিমেন্টে বেষ্টনকৃত রঙিন টিনে আচ্ছাদিত ঘরে সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে। কাশিপুর গুচ্ছগ্রামের ব্লক সলিং রাস্তার দুইপাশে দণ্ডায়মান একেকটি রঙিন পাকা ঘর যেন নগরায়নের ইঙ্গিত বহন করছে। জামালগঞ্জ-মন্নানঘাট সড়ক থেকে পশ্চিম লক্ষীপুরের দিকে তাকালে হলুদ, লাল আর সবুজে মোড়ানো ছিমছাম এক অন্যরকম সৌন্দর্য চোখে পড়ে। এছাড়া সরকারের দেওয়া হাফ বিল্ডিং সদৃশ রঙিন ঘর বেহেলী ইউনিয়নের রাজাপুর বাগহাঁটি ও সাচনা বাজারের হরিহরপুর বাগহাঁটিতে আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এ গ্রামগুলোতে বদলে যাওয়া জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
জানা যায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে জামালগঞ্জের ৬টি ইউনিয়নে ৩০১টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমিসহ ঘর দেওয়া হচ্ছে। আর তাতে প্রথম পর্যায়ের ১৪৬টি একক গৃহ নির্মাণ বাবদ প্রতি ঘরে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা, ২য় পর্যায়ে ৫০টি গৃহ নির্মাণ বাবদ ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং ২য় পর্যায়ে আরও ৫টি গৃহ নির্মাণ বাবদ ২ লাখ করে মোট ৩০১টি ঘরে ব্যয় হচ্ছে ৫ কোটি ২৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দকৃত এসব ঘরের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে ২৫টি, পশ্চিম লক্ষীপুরে ৪৮টি ও কাশিপুর গুচ্ছগ্রামে ২৬টি, ভীমখালী ইউনিয়নের গোলামীপুরে ৯টি, সাচনা বাজার ইউনিয়নের হরিহরপুর বাগহাঁটিতে ৫০টি ও পলকে ১টি, জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামে ৩৪টি, ফেনারবাঁক ইউনিয়নের তেঘরিয়ায় ১৬টি এবং বেহেলী ইউনিয়নের রাজাপুর বাগহাঁটিতে ৩৭টি, ইনাতনগরে ৬টি, রহমতপুরে ১৬টি, উলুকান্দিতে ৮টি ও বদরপুরে ২৫টিসহ মোট ৩০১টি ঘর পাচ্ছেন উপকারভোগীরা। এসব পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিতের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) ব্যবস্থাপনায় প্রতি ১০টি পরিবারের জন্য ১টি করে নলকূপ বসানো হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে রবিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘর হস্তান্তর করেছেন। জামালগঞ্জে ৫৩টি পরিবারের কাছে এদিন ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ২য় পর্যায়ে ২০৯টি ঘর পাচ্ছেন ভূমিহীন ও গৃহহীনরা। এর আগে এই জেলায় ১ম পর্যায়ে বরাদ্দকৃত ৩ হাজার ৯০৮টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিআর/আরআর-০২