সোহেল তালুকদার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ
জুলাই ০১, ২০২১
০৯:৩৫ অপরাহ্ন
আপডেট : জুলাই ০১, ২০২১
০৯:৩৫ অপরাহ্ন
জলমহাল ও জলাশয়গুলো খনন না হওয়ায় ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে হাওরের প্রায় ১০-১২টি প্রজাতির মাছ। সেই সঙ্গে কমেছে মাছের উৎপাদন। তাই এখানকার জেলেদের জাল থাকে মাছশূন্য। দীর্ঘদিন ধরে উজান থেকে নেমে আসা পলি জমে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের খাল, বিল আর জলাশয়গুলোর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় শুকনো মৌসুমে জলাশয়গুলোর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা সময়মতো তাদের কষ্টার্জিত বোরো জমিতে সেচ দিতে পারছেন না। অন্যদিকে জলাশয়গুলোতে পানির গভীরতা না থাকার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় সুস্বাদু মাছগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।
হাওরের এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে মৎস্য অধিদপ্তর। হাওরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ রক্ষায় বেশ কয়েকটি জলাশয় ও বিল খনন প্রকল্পের আওতায় এনে খনন কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার হাওরে সুদিন ফিরে আসবে, বৃদ্ধি পাবে মাছের উৎপাদন।
অন্যদিকে বিল ও জলাশয় খনন হওয়ায় জেলার হাজারো জেলে পরিবার নতুন করে স্বপ্ন বুনছে। তারা বলছেন, এইবার শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হবে না। জালে এবার ব্যাপকভাবে মাছ ধরা পড়বে। তবে তাদের মতে, জেলার প্রতিটি জলাশয় ও নদী খনন হলে আরও উপকৃত হতেন তারা। সেই সঙ্গে রক্ষা পেত বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ।
সুনামগঞ্জ মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে খননের জন্য ৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। জেলার সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা ও দিরাই মোট ৬টি উপজেলায় ৪৫টি স্কিমে ২৮টি জলাশয়ের খননের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের তেহকিয়া গ্রামের মৎসজীবী আব্দুল বারী ও আব্দুল মজিদ বলেন, আমরা ১২ মাসের মাঝে ৮ মাসই মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। আগের তুলনায় এখন আর জালে তেমন মাছ আসে না। কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতে হয়।
জালে মাছ না আসার কারণ হিসেবে এই মৎসজীবীরা বলেন, হাওরের জলমহালগুলো বন্যার পানিতে ভেসে আসা পাহাড়ি পলি মাটিতে দিন দিন ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘ দিন ধরে খনন না করায় হাওরের অনেক প্রজাতির মাছও এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এই বছর কয়েকটি বিল ও জলমহাল খনন হয়েছে। আশা করি আগামীতে মাছের উৎপাদন বেশি হবে আর আমাদের জালেও মাছ বেশি ধরা পড়বে।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নিতাই গাং জলমহালের ইজারাদার কুমড়িয়াইল তেহকিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি নুর আলম বলেন, আমাদের জলমহালটি এ বছর প্রায় ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে শতভাগ খনন করা হয়েছে। এর আগে যতবার ইজারা নিয়েছি ততবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কারণ আগে এই জলমহালের নাব্যতা ছিল না। পলি মাটি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছ পাওয়া যেত না। এ বছর জলমহালটি খনন হওয়ায় আমরা সমিতির লোকজন আগামীতে লাভের মুখ দেখব। আগের তুলনায় এখন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
জেলার দেখার হাওরের বুকে অবস্থিত মাগুরা হাতকাপানিয়া গ্রুপ জলমহালের ইজারাদার তমিজ আলী বলেন, আমাদের বিল প্রায় ভরাট হয়ে গিয়েছিল। এ বছর খনন করা হয়েছে। বিল খনন হওয়ায় আগামীতে কৃষিজমিতে যেমন সেচ দেওয়া যাবে, তেমনি মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। বিল খননের আগে কৃষকরা ধানক্ষেতে পানি সেচ দিতে পারতেন না। বোরো মৌসুমে বিলটি শুকিয়ে যেত, সেই সঙ্গে আশানুরূপ মাছ না পেয়ে বিলের ইজারাদার মৎস্যজীবীরা বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এ বছর থেকে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এভাবে যদি প্রতিটি বিল ও জলাশয় খনন করা হতো, তাহলে হাওরের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতো না।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সাপের দাড়া জলমহালের ইজারাদার ইসলামপুর সলিমপুর গোয়ারছড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি শাহাব উদ্দিন বলেন, আমরা সমিতির লোকজন খনন কাজ পেয়ে সঠিকভাবে শতভাগ খনন সম্পন্ন করেছি। এবার আমরা আশাবাদী, আগামীতে আমাদের সমিতির ইজারাকৃত জলমহাল থেকে লাভবান হতে পারব। নদীটি খনন না হওয়ায় দিন দিন ভরাট হয়ে গিয়েছিল। তাই আগের মতো মাছ পাওয়া যেত না। এবার খনন হওয়ায় আগামীতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আমরা লাভবান হতে পারব।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রানী বিশ্বাস জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলার ৬টি উপজেলায় ৪৫টি স্কিমে ২৮টি জলাশয়ের খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। জলয়াশয়গুলো খনন হওয়ায় হাওরে যেমন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছও রক্ষা করা যাবে।
তিনি জানান, জলাশয়গুলোর গড়ে ৯০ শতাংশ খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় পারিপার্শিক ও প্রাকৃতিক কারণে খনন কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়নি।
সুনামগঞ্জ জেলার মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল জানান, জলাশয় খননের ফলে জেলাবাসী সুফল পাবেন। দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন বাড়বে এবং কৃষকরা তাদের কৃষিজমিতে সেচ দিয়ে অধিক ফসল ফলাতে পারবেন।
তিনি বলেন, এই খাল, বিল ও জলাশয়গুলোর খনন কাজ সবসময় আমাদের মৎস্য অফিসের কর্মকর্তা তদারকি করছেন, যাতে করে নির্দেশনা মোতাবেক সঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ে কাজগুলো সম্পন্ন হয়।
এসটি/আরআর-০১