সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ
জুলাই ০৬, ২০২১
০২:৫৬ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুলাই ০৬, ২০২১
০২:৫৬ পূর্বাহ্ন
'দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি। পরিবারের লোকজনও না খেয়ে আছে। পেট তো লকডাউন মানে না। তাই গাড়ি নিয়ে বের হইছি।' কথাগুলো টোকাই জালাল মিয়ার। এই তরুণের বয়স ২৪ বছর। সুনামগঞ্জের অলি-গলিতে পড়ে থাকা বোতল, প্লাস্টিক ইত্যাদি সংগ্রহ করেন তিনি। সরকার ঘোষিত এক সপ্তাহের 'কঠোর লকডাউনে' অন্য আট-দশজন দরিদ্রের মতো তিনিও বেকায়দায় পড়েছেন। গেল ৪ দিন ধরে প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে ভ্যানগাড়ি নিয়ে বের হতে পারেননি তিনি। তাই কোনো আয়-রোজগারও হয়নি।
জালাল মিয়া জানান, বাবা, ৪ ভাই ও ২ বোনকে নিয়ে সংসার তার। বয়সের ভারে বাবা অনেক আগেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। আট সদস্যের সংসার চালাতে তার অন্য ভাইয়েরা রিকশা চালান। এজন্য অভাব-অনটনের সংসার নামকাওয়াস্তে চলত। কিন্তু করোনা এসে টানাটানির সংসারে দুর্দশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবন চালানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন 'কঠোর লকডাউনের' ফলে একেবারে শূন্য হাত হয়ে গেছে সবার। লকডাউনের প্রথম দিন টেনেটুনে চলা গেলেও গত ৩ দিন চুলায় হাঁড়ি বসেনি তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের দেওয়া এক সপ্তাহের লকডাউনে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর শ্রমজীবী লোকজন। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। আবার অনেক দিনমজুর নিজের কাজে ফিরতে চাইলেও কাজ মিলছে না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে দিন শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন তারা।
কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার বাসিন্দা কালাগাজি। ১২ বছর ধরে সুনামগঞ্জে বাস করে ফেরি করে ব্যবসা করছেন। প্রতিদিন মাঝ বয়সী কালাগাজির কাঁধে উঠত তার বয়সের চেয়েও দ্বিগুণ নতুন নতুন হাঁড়ি-পাতিলের ভার। পা টিপে টিপে চলে মানুষের বাড়ি বাড়ি এসব জিনিসপত্র বিক্রি করতেন তিনি। এতে ভালোই আয় হতো তার। শহরে ১ হাজার ৫০০ টাকা বাসা ভাড়া ও খাওয়ার খরচ মিটিয়ে মাস শেষে কিছু টাকা পরিবারের কাছে পাঠাতেন। কিন্তু গেল ১ সপ্তাহ ধরে তিনি বাসা থেকে বের হতে পারেননি। এতে আয়-রোজগারও হয়নি।
কালাগাজি বলেন, হাঁড়ি পাতিল প্রতিদিন মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতাম। দিন শেষে যা আয় হতো, মহাজনকে দিয়ে আমার কাছে ভালোই টাকা থাকত। এখন কঠোর লকডাউনের ফলে এক সপ্তাহ বের হতে পারিনি। উল্টো মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করে চলছি। এ কয়দিনে মহাজনের কাছে ১ হাজার ৫০০ টাকা ঋণী হয়েছি। তাই লকডাউন অমান্য করে আজকে হাঁড়ি-পাতিলের ভার নিয়ে বের হয়েছি। তবে এখনও এক টাকাও বেচতে পারিনি।
রিকশা, সাইকেলের মেকানিক মো. আব্দুল সালাম। পৌরশহরের মল্লিকপুরের বাসিন্দা তিনি। তিনি বলেন, লকডাউন দিয়েছেন এটা ভালো। ভাইরাসের প্রকোপ কমবে সেটা আমরাও চাই। তবে আমরা খাব কী? কেউ তো এখনও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করছেন না। আমরা কিভাবে চলব, কিভাবে খাব এ নিয়ে কেউ কিছু বলে না। এখন ধার-দেনা করে কোনোভাবে চলছি। এই লকডাউন আমাদের একেবারে জানে মেরে ফেলছে।
রিকশাচালক গোলচান্দ বলেন, আমার ৫ ছেলে-মেয়ে। সবাই ছোট। কেউ এখনও কাজ করার উপযুক্ত হয়নি। তাই আমি একাই রিকশা চালিয়ে সংসার চালাই। রিকশার চাকা ঘুরলে পেট চলে। লকডাউনের আগে যে রোজগার করেছি, তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলছে। আর এখন সারাদিনে ২০০ টাকাই রোজগার করতে পারি না। বউ-বাচ্চা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে।
রিকশাচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, লকডাউনে চলতে পারছি না। বাচ্চাদের খাওয়াতে পারছি না। আমদের তো এখন জীবন বাঁচানোই কষ্ট! যাদের সরকারি চাকরি আছে, তাদের তো সমস্যা নেই। বেতন ঠিকমতো পায়। আমরা কষ্ট করে পরিশ্রম করে খাই। শান্তি যা ছিল চলে গেছে, এখন লকডাউনে অশান্তির দিন এসেছে।
হাছন নগরের বাসিন্দা হেলেনা জানান, তিনি মানুষের বাসায় কাজ করতেন। করোনাভাইরাসের কারণে বাসার কাজ হারিয়েছেন তিনি। এখন সারাদিন মানুষের বাসায় বাসায় কাজের জন্য ঘোরেন। দিন শেষে কাজ না পেয়ে খালি হাতে বাসায় ফিরতে হয় তাকে।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট খলিল রহমান বলেন, সরকার এর আগে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এবার এখনও সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়ার কোনো কার্যক্রম আমরা দেখছি না। যাদের লকডাউনের আওতায় বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই, তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের স্বচ্ছল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
লকডাউনে বিপাকে পড়া মানুষদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা রয়েছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, দুই-একদিনের মধ্যেই আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করব। আগামীকাল (আজ সোমবার) জামালগঞ্জের সাচনা বাজারে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে। আমি সেখানে যাব। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব জায়গায় বিপাকে পড়া মানুষদের মানবিক ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হবে।
এএম/আরআর-১৭