সিলেট মিরর ডেস্ক
জুলাই ২০, ২০২১
০১:৩৯ অপরাহ্ন
আপডেট : জুলাই ২০, ২০২১
০১:৩৯ অপরাহ্ন
ফাঁস হওয়া একটি ডাটাবেস থেকে পেগাসাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রায় ৫০ হাজার ফোন নম্বরের সন্ধান পেয়েছিল প্যারিসভিত্তিক ফরবিডেন স্টোরিজ এবং লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এই ডাটাবেস নিয়ে গার্ডিয়ান, দ্য ওয়্যারসহ ১৬টি সংবাদমাধ্যম অনুসন্ধান চালায়, যার নাম দেওয়া হয় 'পেগাসাস প্রজেক্ট'।
এই প্রজেক্ট সম্পর্কে অনুসন্ধানে যুক্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্নেষণে বলা হয়েছে, পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয় মূলত 'টার্গেটেড ইন্টারসেপশনে'র জন্য। অর্থাৎ নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা লক্ষ্যবস্তু স্থির করে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তার স্মার্টফোন দখলে নেওয়া হয়। সফটওয়্যারটি মূলত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া ব্যক্তির মাইক্রোফোন, স্পিকার ও ক্যামেরার দখল নেয়। পাশাপাশি স্মার্টফোনের গ্যালারি ও ম্যাপিংয়ের মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোও নিয়ন্ত্রণে রেখে সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। ফোনের কথোপকথন তো বটেই, মাইক্রোফোন দখলে থাকার স্মার্টফোনটি কেউ টেবিলে কিংবা পকেটে রেখে কারও সঙ্গে সামনাসামনি বসে আড্ডা বা আলাপচারিতা চালালেও তাও রেকর্ড হয়ে যায়। পাশাপাশি ক্যামেরা দখল নিয়ে গোপনে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত ব্যক্তির প্রতি মুহূর্তের চলাফেরার ভিডিওচিত্রও ধারণ করতে থাকে। এমনকি স্মার্টফোন যদি শাটডাউন বা পাওয়ার অফ অবস্থায় থাকে, তাহলেও পেগাসাস মাইক্রোফোনে ভয়েস রেকর্ড এবং ক্যামেরায় ভিডিওচিত্র ধারণ করতে পারে। এক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ব্যাটারিতে চার্জ থাকলেই কাজ হয়। স্মার্টফোনটি পুনরায় চালু করার পর ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ অবস্থায় করা ভয়েস রেকর্ড কিংবা ভিডিওচিত্র পেগাসাসের নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি বা সংস্থার সার্ভারে চলে যায়।
ডাটাবেস থেকে বেছে নেওয়া ব্যক্তিদের ফোনের তথ্যের ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্নেষণ করে অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে পেরেছে। তারা জানিয়েছে, স্পিকার ও মাইক্রোফোন দখলে থাকার কারণে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার, সিগন্যালের মতো এন্ড টু এন্ড এনক্রিপটেড ওটিটি অ্যাপের আলাপচারিতাও রেকর্ড করতে পারে পেগাসাস। কেউ ভিডিও কলে কথা বললে ক্যামেরায় যা দেখানো হচ্ছে, তাও রেকর্ড করতে পারে ক্যামেরার দখলের কারণে। আবার পেগাসাস দখল নেওয়া স্মার্টফোনের গোপন স্ক্রিণশট নিতেও সক্ষম। ফলে মেসেঞ্জারে যা লেখা হচ্ছে, তারও স্ক্রিণশট রেকর্ড হয়ে যায়। ফলে এনক্রিপশন না ভেঙে পেগাসাস এনক্রিপটেড অ্যাপের সব ধরনের আলাপচারিতাই গ্রাস করতে সক্ষম।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, একটি বাক্যে এই সফটওয়্যারের ক্ষমতা সম্পর্কে বলে দেওয়া যায়। তা হচ্ছে, 'আপনি যদি স্পাইয়িং সফটওয়্যার পেগাসাসের দখলে থাকেন, তাহলে আপনার 'ব্যক্তিগত গোপনীয়তা' বলে আর কিছু নেই। তিনি আরও জানান, পেগাসাস সফটওয়্যারটি এতই শক্তিশালী যে এক দেশে বসে অন্য দেশের যে কারও স্মার্টফোন দখলে নিয়ে তার ভয়েস রেকর্ড শুধু নয়, প্রতি মুহূর্তের কার্যক্রমের ভিডিও রেকর্ড করা সম্ভব। ফলে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করার অর্থ-ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাহীন প্রত্যেকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে রাখা। এই সফটওয়্যার আপনাকে দখলে রেখেছে কিনা, তা জানাও অত্যন্ত কঠিন। কারণ পেগাসাসের জাল সম্পর্কে জানতে হলে এই সফটওয়্যার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ টিমের প্রয়োজন।
মূল টার্গেট সাংবাদিক, রাজনীতিক ও মানবাধিকারকর্মী
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেগাসাসের গ্রাহকদের মূল লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিক, রাজনীতিক ও মানবাধিকারকর্মীদের নাম দেখা গেছে। বিশেষ করে হাঙ্গেরি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক এবং ভারতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নাম পেগাসাস প্রোজেক্টের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। গার্ডিয়ান আরও জানায়, ফাঁস হওয়া ডাটাবেসের ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকরা স্পাইয়িং শুরু করেছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় ৪৫টি দেশে পেগাসাস ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। দেশগুলো হচ্ছে, আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, মিসর, ফ্রান্স, গ্রিস, ভারত, ইরাক, ইসরায়েল, আইভরি কোস্ট, জর্ডান, কাজাখস্তান, কেনিয়া, কুয়েত, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লেবানন, লিবিয়া, মেপিকো, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, পোল্যান্ড, কাতার, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া।
কানাডার সিটিজেন ল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ৩৬টি পেগাসাস সিস্টেম এই ল্যাবে শনাক্ত করা গেছে, যেগুলো প্রত্যেকের এক একটি অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। এই ৩৬টি পেগাসাস সিস্টেম থেকে ৪৫টি দেশে নজরদারি চালানো হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি অপারেটর নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে বা 'ক্রসবর্ডার' স্পাইয়িং কার্যক্রম চালিয়েছে। 'গঙ্গা' নামের একটি অপারেটর পেগাসাস ব্যবহার করে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, হংকং, ভারত ও পাকিস্তানে নজরদারি চালিয়ে আসছে।
ভারতের নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেগাসাসের তালিকায় ভারতের রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও বিজ্ঞানীর নাম রয়েছে। অবশ্য ভারত সরকারের একজন মুখপাত্র এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এদিকে পেগাসাস দিয়ে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার আগে ও পরে তার ঘনিষ্ঠজনদের মুঠোফোনেও আড়ি পাতা হয়েছিল। আড়িপাতা হয় খাসোগির স্ত্রী হানান এলাতার ও তার বাগদত্তা হেতিজে চেঙ্গিসের ফোনে।
পেগাসাস প্রজেক্টের ডেটার ডিজিটাল ফরেনসিক বিশ্নেষণ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরীক্ষাগারে। এ তদন্তের জন্য ৬৭টি মোবাইল ফোনের তথ্য বিশ্নেষণ করা হয়েছে।
এএফ/০২