হাওরে পানি কম থাকায় নেই মাছ, কৃষি বিপর্যয়ের শঙ্কা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


আগস্ট ০৮, ২০২১
০৫:৩২ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ০৮, ২০২১
০৫:৩২ অপরাহ্ন



হাওরে পানি কম থাকায় নেই মাছ, কৃষি বিপর্যয়ের শঙ্কা

বাংলা দিনপঞ্জি অনুযায়ী এখন শ্রাবণ মাস, ঘোর বর্ষাকাল। কিন্তু এই সময়ে চারপাশ পানিতে টইটম্বুর থাকার বদলে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের হাওর, নদী, খাল, বিলে মরা কার্তিকের আবহ ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে উজান ও পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরেক রকমের দেশীয় মাছ ভেসে আসে পানিতে। তবে এ বছর হাওর-বাঁওড়ে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় হাওরাঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষ।

প্রতিবছর বর্ষায় কম-বেশি মাছ পাওয়া গেলেও এ বছর পানি স্বল্পতা প্রকট আকার ধারণ করায় জলাশয়ে মাছের দেখা নেই। যা মিলছে তা দিয়ে একদিকে যেমন স্থানীয়দের আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, অন্যদিকে জেলেদের জীবিকা নির্বাহের পথও রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় হাওরপাড়ের মাছ কিনে খাওয়া মানুষ ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মাঝে এক অদ্ভুত সংকটকাল অতিক্রমের প্রবণতা চোখে পড়ছে। এছাড়া ঘোর বর্ষাকালে এসে হাওরে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কৃষি বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও প্রবল হয়ে উঠেছে। মৎস্য ও কৃষি দুয়ে মিলে এমন বৈরি পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় চরম হতাশা ও শঙ্কা কাজ করছে হাওর তীরবর্তী মানুষের মনে।

জানা যায়, শুধু হাওরাঞ্চলের মানুষই নয়, পুরো দেশই কোনো না কোনোভাবে হাওরের কৃষি ও মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। মাছ ও ভাতের সংস্থান করা হাওরগুলো এ বছর প্রচণ্ড পানি স্বল্পতায় ভুগছে। এ সময়টায় যেখানে হাওর-বাঁওড় পানিতে ভরপুর হওয়ার কথা, সেখানে পানি শুকিয়ে হেমন্তকালীন পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে। হাওরপাড়ের যেসব জায়গায় এ সময় অন্যান্য বছর প্রায় কোমর সমান পানি ছিল, এ বছর সে জায়গা দিয়ে হেঁটে চলাচল করছে পথচারীরা। কোনো কোনো জায়গায় হাওর রক্ষা বাঁধও শুকিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কেউ কেউ।

মৎস্যজীবী, কৃষক ও হাওরের সচেতন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিকট অতীতে পানি নেমে যাওয়ার এমন শুষ্ক ভাব তেমনটা দেখা যায়নি। কোনো কোনো বছর পানি কম হয়েছে, কিন্তু ঘোর বর্ষায় এসে এভাবে কার্তিকের অবস্থা কখনও হয়নি। গতবছর টানা তিন দফা বন্যায় মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ বছর পানি না থাকার দরুণ অন্যরকম ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন হাওরবাসী।

এদিকে, যেভাবে পানি শুকাচ্ছে তাতে হাওরে মাছ নেই। অপরদিকে পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় কৃষি মৌসুমে সেচ সংকটে পড়বেন কৃষকরা। এছাড়া বর্ষার শেষ সময়ে এসে যদি বন্যা দেখা দেয়, তাহলে সে পানি সহজে যাবে না। তাতে বোরো ফসলের বীজতলা শুকাতে দেরি হবে এবং যথাসময়ে ধান রোপণ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন অনেকে।

ভরা বর্ষা মৌসুমে হাওরে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কৃষিকাজে মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে জানিয়ে বেহেলী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মসিউর রহমান বলেন, আমার ওয়ার্ডের একটি গ্রাম (হিজলা) আছে যার পুরোটাতেই মৎস্যজীবীদের বাস। হাওরে পানি নেই, তাই মাছ মারতে না পারায় এ গ্রামের অনেকে পেটের তাগিদে অন্যত্র চলে গেছেন। এ অবস্থায় মৎস্যজীবীদের জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়েছে। পাশাপাশি হাওরপাড়ের মানুষের যে মাছের চাহিদা আছে, সেটাও মিটছে না। এছাড়া হাওররক্ষা বাঁধ শুকিয়ে যাওয়ায় হাওরের বিল ও ডোবায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ঢুকতে পারবে না। তাই হেমন্তকালেও মাছের অভাব বোধ করবে হাওরপাড়ের মানুষ।

বেহেলী ইউনিয়নের হিজলা গ্রামের রতন বর্মণ ও নিরঞ্জন বর্মণ জানিয়েছেন, বেকার অবস্থায় দিন পার করছেন তারা। বর্ষাকালে তাদের অন্যতম পেশা যেহেতু মৎস্য আহরণ, সেহেতু মাছ মেরেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদেরকে। এ বছর হাওরে পানি নেই, মাছও নেই। তাই তাদের গ্রামের অন্তত ৫০টি পরিবারের দিনাতিপাত করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তাদের গ্রামের সামনে যে একটি নদী আছে, তাতেও মাছ ধরতে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের অভাব আরও বাড়তে থাকবে বলে জানিয়েছেন তারা।

ফেনারবাঁক ইউনিয়নের গঙ্গাধরপুর গ্রামের কৃষক জগদীশ তালুকদার বলেন, পানি যেভাবে টান পড়েছে এ রকম চলতে থাকলে কৃষির জন্য মারাত্মক সমস্যা হবে। বীজতলা প্রস্তুত করতে তখন পানি পাওয়া যাবে না। ধানের চারা যদি না হয়, তাহলে পুরো কৃষিকাজই থমকে যাবে।

জামালগঞ্জ উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, গত কয়েকদিন আগে আমি পাগনা হাওর ঘুরে এসেছি। সেখানে কয়েকটি বাঁধ শুকিয়ে গেছে। শুকনো এ বাঁধ দিয়ে পুরোদস্তুর হেঁটে চলাচল করা যায়। এ সময়টায় চারপাশ পানিতে নিমজ্জিত থাকে। কিন্তু এ বছর পানি নেই। নতুন পানি এলে হাওরে মাছ আসে। তাতে জেলেদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম হওয়ার পাশাপাশি এলাকার মানুষের আমিষের চাহিদাও পূরণ হয়। এই যে প্রকৃতিগত একটা বৈরি অবস্থা, এতে আগামী বোরো মৌসুমে প্রচণ্ড সমস্যার সৃষ্টি হবে। এজন্য কৃষি অধিদপ্তরকে হাওরপাড়ের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আগামীর সমস্যা মোকাবেলায় করণীয় বিষয় ঠিক করতে হবে।

এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা মো. মাশরেফুল আলম জানিয়েছেন, হাওরে পানি নেই ঠিক, তবে আমন-আউশের জন্য ভালো হয়েছে। এখন দিনে রোদ থাকে, রাতে বৃষ্টি হয়। এতে করে আমনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। অপরদিকে হাওরে পানি কম থাকায় বোরো আবাদে বিপর্যয়ের সম্ভাবনার বিষয়টি ভাদ্র মাসের পরে বোঝা যাবে। ভাদ্র মাসের পর যদি এ রকম চলতে থাকে, তাহলে আমরা পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।


বিআর/আরআর-০১