বিশ্ব আদিবাসী দিবস : স্বীকৃতি চান খাসিয়ারা

জিয়াউল হক জিয়া, কুলাউড়া


আগস্ট ০৯, ২০২১
০৬:২৯ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ০৯, ২০২১
১০:৪৯ অপরাহ্ন



বিশ্ব আদিবাসী দিবস : স্বীকৃতি চান খাসিয়ারা

বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় বসবাস খাসিয়া ও গারো জনগোষ্ঠীর। খাসিয়া ও গারো জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার অবলম্বন জুম চাষ। যার মধ্যে অন্যতম হলো পান চাষ। বেশিরভাগ খাসিয়া ও গারো তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন এই পান থেকে। নিজেদের আদিবাসী দাবি করা এ জনগোষ্ঠী এখনও পাননি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বিভিন্ন পানপুঞ্জিতে পানের চাষাবাদ হয়ে থাকে ব্যাপকভাবে। এই পানকে কৃষিপণ্য হিসেবে স্বীকৃতিসহ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার দাবি জানিয়েছে খাসিয়া ও গারো জনগোষ্ঠী।

খাসিয়াদের পান চাষে যেমন বৈচিত্র রয়েছে, তেমনি সিলেটসহ সিলেটি অধ্যুষিত বহির্বিশ্বে এর চাহিদাও রয়েছে তুঙ্গে। কুলাউড়া উপজেলায় পানপুঞ্জি বেশি থাকায় লংলা পরগনায় গড়ে উঠেছে সর্ববৃহৎ রবিরবাজার পানের আড়ৎ। সেখান থেকে পান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এর ফলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও এ পান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 

খাসিয়া পানপুঞ্জি সূত্রে জানা গেছে, কুলাউড়ার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ছোট-বড় ৪৫টি পানপুঞ্জি রয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের প্রায় ২৩টি পানপুঞ্জিতে পানের চাষাবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। পুরাতন গাছ থেকে কাটিং করে পানের চারা রোপণ করা হয়। চারা রোপণের ১ বছর পর গাছ থেকে পান উৎপাদন শুরু হয়ে ৩ বছর পর্যন্ত ওই গাছ থেকে পান সংগ্রহ করা হয়। পানগুলো পাহাড়ের সারি সারি টিলায় সুপারি গাছ ও অন্যান্য গাছে চাষাবাদ হয়।

জুখাসিয়া পুরুষরা লু-উ নামে এক ধরনের বাঁশের মই দিয়ে পান তোলে থাকেন। পান তোলার সময় তারা সঙ্গে পান সগ্রহ করার জন্য ঝুড়ি রাখেন। এই পান তুলে রাখা হয় ঝুড়িতে। পরে পান সংগ্রহ করে জুম থেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন খাসিয়া পুরুষরা। আর খাসিয়া নারীরা ঘরে বসে পান গুছিয়ে তা বিক্রি করেন। প্রথা অনুয়ায়ী সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পানের ‘লংখং’ বা গাছের সম্পূর্ণ পান তোলা হয়ে থাকে। মার্চ-এপ্রিল এই দুইমাস গাছে পান তেমন থাকে না। তবে এবার আগাম বৃষ্টি হওয়ায় পানের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানা গেছে। 

খাসিয়া সমাজে মেয়েদের প্রাধান্য বেশি। মেয়েরা ধন-সম্পদের উত্তরাধিকারী। খাসিয়া আদিবাসীরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। বংশ পরিচয় দেওয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। তাই পরিবারে নারীদের অধিকারই বেশি। পুঞ্জিতে অনেক পরিবারের ৪-৫টি পানের জুম থাকে এবং নূন্যতম একটি পরিবারের ১-২টি পানের জুম থাকে। 

পান চাষ করতে গিয়ে পানের বিভিন্ন রোগ ধরা পড়ে। উথ্রাম (পান পঁচা) নামের একটি রোগ মারাত্মকভাবে পানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া পান গাছের লতা পচা ক্লাম নামের একটি বিষাক্ত রোগ রয়েছে। সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হলে আর পানের যতœ না নিলে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পানগুলো লালচে হয়ে যায়। তখন তারা নিজেদের মতো পানের গোড়ায় চুন দিয়ে থাকেন।

খাসিয়ারা জানান, তারা নিজেরা আদি ফর্মুলায় পান চাষ করে থাকেন। কৃষি বিভাগের কোনো সহযোগিতা ছাড়াই তারা এ চাষাবাদ করে আসছেন। পানকে কৃষিপণ্য হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তাদের।

তারা আরও জানান, এক কুড়ি নতুন পানের (নই) দাম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর খাসিয়া পুরাতন পান এক কুড়ির দাম ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমান মৌসুমে সপ্তাহে যেদিন পান বিক্রি হয়, সেদিন পুঞ্জিগুলোত প্রতি পরিবার থেকে ৫ কুড়ি পান বিক্রি থেকে ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা আয় করে থাকে। এই পান চাষকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে ৪৫০ থেকে ৫০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। পুঞ্জি থেকে ৩০-৪০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে পানগুলো আড়তে নিয়ে যাওয়া হয়। পুঞ্জি থেকে প্রায় ২০০ শ্রমিক পানগুলো পাহাড়ি টিলা বেয়ে গাড়িতে করে নিয়ে আসেন। প্রতিজন শ্রমিক পারিশ্রমিক হিসেবে দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত পান। 

কুলাউড়া উপজেলার সর্ববৃহৎ পানের আড়ৎ রবিরবাজারে অবস্থিত। বিভিন্ন পাহাড়ের গহীনে চাষকৃত এসব পানের সিংহভাগই আসে রবিরবাজারের বিভিন্ন আড়তে। রবিরবাজারে ৩টি মার্কেটে ছোট-বড় প্রায় ৬০টি পানের আড়ৎ রয়েছে। ১২০ থেকে ১৩০ জন মহাজন রয়েছেন এখানে।

আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন (কুবরাজ) এর সাধারণ সম্পাদক ও কুলাউড়া মুরইছড়া পানপুঞ্জির মান্ত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, পান চাষকে এখনও সরকারিভাবে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পান চাষে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু কুলাউড়ায় এ সুযোগ নেই। পান চাষের সঙ্গে আদিবাসী ছাড়াও অনেক বাঙালি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। পান চাষকে শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।


জেএইচ/আরআর-০৩