গাছ ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ

এ জে লাভলু, বড়লেখা


আগস্ট ২৪, ২০২১
১১:২৯ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ২৪, ২০২১
১১:২৯ অপরাহ্ন



গাছ ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ

বিধিবহির্ভুতভাবে গাছ ও বাঁশকে খুঁটি বানিয়ে গ্রাহকের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংযোগ দেওয়ার প্রায় দেড় দশক অতিবাহিত হলেও সংস্কার করা হয়নি এসব ঝুঁকিপূর্ণ লাইন। ঝুঁকিপূর্ণ এসব লাইনে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। যে কোনো সময় আরও বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। এমন অব্যবস্থাপনার চিত্র মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ ইউনিয়ন এলাকায়। এ ঝুঁকির পাশাপাশি ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল, লো ভোল্টেজের ভোগান্তিতে আছেন এলাকার ৫ শতাধিক গ্রাহক।

ঝুঁকিপূর্ণ লাইন সংস্কার, লো ভোল্টেজ ও ভুতুড়ে বিলের সমাধান এবং লাইন সংস্কারের নামে অর্থ নেওয়ার অভিযোগে পিডিবি কুলাউড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে গত ১৬ আগস্ট একটি লিখিত আবেদন করেছেন এলাকাবাসী। অনুলিপি দেওয়া হয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক, বিউবো সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী, মৌলভীবাজার কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বড়লেখা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে।

বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী যে কোনো এলাকার সাধারণ গ্রাহকদের বিদ্যুৎ প্রদানের জন্য ৩টি ফেজ আর ১টি নিউট্রাল তারের ফোর ফোরটি এলটি লাইন স্থাপন করে সংযোগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এ ফোর ফোরটি এলটি লাইন থেকে সিঙেল ফেজ (একটি ফেজ ও নিউট্রাল) তার দিয়ে গ্রাহকের বাড়িতে সংযোগ দিতে হয়। তারও আগে কোনো গ্রাহক বিদ্যুতের সংযোগের জন্য আবেদন করলে উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে সরেজমিনে জরিপ করে সহকারী প্রকৌশলীকে প্রতিবেদন দিতে হয়। সহকারী প্রকৌশলীর প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুমোদন সাপেক্ষে সংযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, পিডিবির উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ফোরম্যান আর লাইনম্যানের অসাধু সিন্ডিকেট আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে অফিসে বসে ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে বড়লেখার কাশেমনগর, দোহালিয়া, গজভাগ, পুটাডহরসহ বিভিন্ন গ্রামে বাঁশের খুঁটি, কাঠের খুঁটি ও জীবন্ত গাছে তার টেনে ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ প্রদান করেছে।

আবেদন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের কাশেমনগর, পুটাডহর, দোহালিয়া ও গজভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আওতায় অন্তত ৫ শতাধিক গ্রাহক আছেন। প্রায় ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে ওই এলাকাগুলোতে এক ফেজ (কভার তার ছাড়া) দিয়ে বিদ্যুতের লাইন স্থাপন করা হয়েছে। সংযোগ প্রদানের শুরুর দিকে কিছু পাকা খুঁটি দিয়ে সঞ্চালন লাইন টানা হয়। তবে বেশিরভাগই ব্যবহার করা হয়েছিল গাছ ও বাঁশের খুঁটি। একসময় পাকা খুঁটিগুলো ভেঙে গেলে পিডিবির লোকজন জীবন্ত গাছসহ গাছ ও বাঁশকে খুঁটি বানিয়ে সঞ্চালন লাইন টেনে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে। এসব তার কোথাও ভূমি থেকে প্রায় ৭ ফুট কোথাও ৮ ফুট উপরের দিকে টেনে নেওয়া হয়েছে। অনেকেই অসাবধানতাবশত ওই গাছ ও বাঁশের খুটিতে স্পর্শ করে বিদ্যুতের শক খেয়েছেন। গ্রামগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার প্রায় দেড় দশক পার হলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। এছাড়া লো ভোল্টেজের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখা পড়ায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। ফ্যান, ফ্রিজ, পানির মোটর কোনো কিছুই ঠিকমতো চলে না। লো ভোল্টেজের কারণে ফ্রিজ, মোটর নষ্ট হয়েছে অনেকের। এর মধ্যে নতুন নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে অভিযোগ করা হয়েছে, লাইন মেরামত ও সংস্কারের নামে প্রায় ২ বছর আগে পিডিবির লাইনম্যান পরিচয় দেওয়া রবিউল আলম পিডিবি কর্মকর্তাদের নামে ১ লাখ টাকার চুক্তি করে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে ৪৫ হাজার টাকা নেন। 

কাশেমনগর গ্রামের বাসিন্দা বদরুল ইসলাম বলেন, অনেক কষ্ট করে আমরা নিয়মিত বিল দিচ্ছি। ন্যুনতম সেবাও পাচ্ছি না। মিটার না দেখে দেওয়া ভুতুড়ে বিলও পরিশোধ করছি। কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার করা হচ্ছে না। হাঁটা-চলা ও মাঠে চাষাবাদের সময় বিদ্যুতের তার গায়ে লাগার মতো নিচে ঝুলে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। জরাজীর্ণ বিদ্যুৎ লাইন ও লো ভোল্টেজ সত্ত্বেও একের পর এক এলাকায় নতুন সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে লো ভোল্টেজের বিদ্যুৎ আমাদের কোনো কাজে আসছে না। বিদ্যুৎ পাওয়ার পর থেকেই আমরা নিরীহ গ্রাহকরা নানা হয়রানির শিকার।

অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম লাইন সংস্কারের নামে ৪৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি পিডিবির কর্মী নই। স্থানীয় গ্রাহকরা লাইন সংস্কারের ঠিকাদারকে টাকা দিয়েছেন। ওইসময় আমি শুধু উপস্থিত ছিলাম।

স্থানীয় দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজির উদ্দিন বলেন, প্রধান সমস্যা হচ্ছে লো ভোল্টেজ। একটি পরিবারের সব লাইট বন্ধ করে কোনোরকমে একটি ফ্যানও চালানো যায় না। পরিবারের সকলে এক সঙ্গে বিদ্যুৎ সুবিধা পায় না। এছাড়া লাইন খুলে পড়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগতভাবে টাকা দিয়ে এলাকাবাসী লাইন এনেছে। পিডিবি দায়িত্ব নেওয়ার পরেও ট্রান্সফরমার চেঞ্জ করে না। গ্রাহকদের নিজেদের টাকায় ট্রান্সফরমার কিনে আনলে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। লাইনটি ঝুঁকিপূর্ণ, এটাও সংস্কার করা হচ্ছে না। বিশেষ করে বাচ্চাদের লেখাপড়ায় লো ভোল্টেজের কারণে বিঘ্ন ঘটছে। ট্রান্সফরমারে পাশের দুই-চার পরিবারের বাচ্চারা ছাড়া রীতিমতো কোনো পরিবারের বাচ্চারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে লেখাপড়া করতে পারে না। ফ্রিজ, টিভি, মোটর তো চলেই না। দ্রুত এটির সমাধান হওয়া জরুরি। 

এ ব্যাপারে পিডিবির কুলাউড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী উসমান গণি বলেন, এলাকাবাসীর লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। গাছ ও বাঁশ দিয়ে জোর করে তো কারও বাড়িতে লাইন দেওয়া হয়নি। তখন স্থানীয় নেতা কিংবা কারও জোরাজুরি, তদবির থাকায় এভাবে লাইনগুলো হয়েছে। কিন্তু গাছ ও বাঁশের খুঁটি এবং এক লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার কোনো বিধান নেই। এখন একটি প্রজেক্ট আসছে। সব সমস্যার সমাধান হবে। কিছু কাজ শুরু হয়েছে।

পিডিবির নামে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, রবিউল নামে আমাদের কোনো কর্মী নেই। পিডিবির নামে কেউ চাঁদাবাজি করলে আমরা কী করব?


এজে/আরআর-০৯