ভূমিহীন পরিবারের ঘর পেল বিত্তশালী পরিবার

ওসমানীনগর প্রতিনিধি


ডিসেম্বর ২৪, ২০২১
০৪:১২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ২৪, ২০২১
০৪:১৩ পূর্বাহ্ন



ভূমিহীন পরিবারের ঘর পেল বিত্তশালী পরিবার
ওসমানীনগরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম

সিলেটের ওসমানীনগরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকৃত ভ‚মিহীন পরিবারকে বঞ্চিত করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বিত্তশালী একটি পরিবারকে। এ ঘটনায় ভূমিহীন আছিয়া বেগম চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। 

অভিযুক্তরা হলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়া, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকতা অনিল সিংহ, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত হাসুরা বেগমের ২ ছেলে নূর মোহাম্মদ ও নূর জামান। 

মামলা সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নে বাংলাবাজার এলাকায় সম্মানপুর মৌজার ৮৩৫ দাগের সরকারি খাস ভ‚মিতে ৩ টি ঘর নির্মাণ করা হয়। ভ‚মিতে বিগত ২২ বছর ধরে মোছা. আছিয়া বেগম পরিবার নিয়ে বাস করছিলেন। আছিয়া বেগমের স্বামী রিকশাচালক রুবেল মিয়া সাদিপুর ইউনিয়ন কর্তৃক ভ‚মিহীন সনদপ্রাপ্ত। গত ২ এপ্রিল ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা অনিল সিংহ, আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়াসহ কয়েকজন আছিয়া বেগমকে জানান উক্ত ভ‚মিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩ টি ঘর নির্মাণ হবে। এবং এর মধ্যে একটি ঘর আছিয়া বেগমকে দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতিতে তাকে জমি খালি করে দিতে বলেন। এরপর আছিয়া বেগম সরকারি ভূমি ছেড়ে দিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে জোড়াতালি দিয়ে ঘর বানিয়ে স্বামী সন্তানকে নিয়ে বাস করছেন। পরবর্তীতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে খরচ বাবদ আছিয়া বেগমের কাছে ৩০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। গত ১১ জুন আছিয়া বেগম টাকা আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়া, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দপ্রাপ্ত নুর মোহাম্মদ ও নুর জামানের হাতে তুলে দেন। আগস্টের শেষ দিকে ঘর নির্মাণ শেষ হলে একটি ঘর আছিয়া বেগমকে মৌখিকভাবে সমঝে দেওয়া হয়। গত ১ অক্টোবর বিকেলে আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন অভিযুক্তরা। আছিয়া বেগম টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে স্বামী-সন্তানসহ আছিয়া বেগমকে মারপিট করে জোরপূর্বক ঘর থেকে বের করে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত নুর মোহাম্মদ এবং নুর জামানের মা হাসুরা বেগম ভ‚মিহীন না হয়েও ১ ও ২নম্বর অভিযুক্তের সহায়তায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্ধ পেয়েছেন।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত ৩ টি ঘরে দিনমজুর নজরুল মিয়া, টমটম চালক নূর মোহাম্মদ ও হাসুরা বেগম বরাদ্দ পেয়েছেন। হাসুরা বেগমের নিজ নামীয় ৫ শতক ভূমি ও তার ওপর নির্মিত একটি টিনশেডের পাকা ভবন রয়েছে। হাসুরা প্রথম সন্তান আ. কাদির প্রবাসী, ২য়  ছেলে টমটম চালক নূর মোহাম্মদ (আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন) ও ৩য় ছেলে পিক-আপ চালক নুর জামান মায়ের সাথে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পৃথক ঘরে বাস করছেন। 

অভিযোগকারী আছিয়া বেগম বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এ ভূমিতে ঘর বানিয়ে বাস করছি। বসত বাড়ির ইউপি ট্যাক্স প্রদান করছি। আমার স্বামীর নামে ভূমিহীন সনদ রয়েছে। নিজস্ব বৈদ্যুতিক মিটারও রয়েছে। আমাদের উক্ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। নিজেদের বাড়ি রয়েছে এমন পরিবারের ২ জনের জন্য ২টি ঘর বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আহবাব মিয়া গংদের চাহিদা মাফিক টাকা দিতে না পারায় আমি ঘর পাইনি। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি।’

অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা আহবাব মিয়া বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি নই। ঘর বরাদ্দের ব্যাপারে কোথাও আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। আছিয়া বেগম উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছেন।’

নিজের নামে ভূমি নেই দাবি করে হাসুরা বেগম আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর বরাদ্দের দলিল দেখিয়ে জানান, তার ছেলে নূর মোহাম্মদ পরিবার থেকে আলাদা। তাই নুর মোহাম্মদের নামে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে। তার (হাসুরা বেগমের) মালিকানায় ভূমির দলিল রয়েছে জানালে তিনি বলেন-এসব মিথ্যা। 

হাসুরা বেগমকে ভূমিহীন সনদ প্রদান প্রসঙ্গে স্থানীয় ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা ইউপি সদস্য আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমি মহিলা হয়ে সব জায়গায় যাওয়া বা সবকিছু ভালো করে যাচাই করা সম্ভব নয়। স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার শনাক্তের ভিত্তিতে আমি হাসুরা বেগমকে ভূমিহীন সনদ দিয়েছি। পরবর্তীতে জেনেছি হাসুরার নিজস্ব বাড়ি রয়েছে।’  

ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা অনিল সিংহ বলেন, ‘ভূমিহীন সনদ পেয়েই হাসুরা বেগমের নামে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। ঘর তিনটি, কিন্তু দাবিদার চারজন। তাই যারা আগে যোগাযোগ করেছেন তাদেরকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আছিয়া বেগমের জন্য অন্যত্র ঘরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা কবির উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আছিয়া বেগমের ঘর না পাওয়ার বিষয়টি অমানবিক। এতে শেখ হাসিনার মহৎ উদ্যোগটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। ভূমিহীন আছিয়া বেগমের জন্য ঘর নির্মাণের জন্য প্রশাসন আন্তরিক রয়েছে।’

হাসুরা বেগমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই মহিলা ভূয়া হলফনামা দিয়ে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। আর্থিক কেলেঙ্কারীর বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আমি হাসুরাকে তিনদিনের মধ্যে ঘর ছেড়ে দিতে বলেছি। অন্যথায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নীলিমা রায়হানা বলেন, ‘এটা আমার যোগদানের পূর্বের ঘটনা। তাই সব স্পষ্ট বলতে পারছি না। আমি আছিয়া বেগমের বিষয়টি জেনে তাকে ঘর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। আর হাসুরা বেগমের যদি নিজস্ব বাড়ি থেকে থাকে তবে তিনি কীভাবে ঘর পেলেন বা কোনো প্রকার দুর্নীতি হয়েছে কি না খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’    

ইউডি/বিএ-০৩