স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ঝাঁপ দেন তিনি, বড় মেয়ে তখনও লঞ্চে

সিলেট মিরর ডেস্ক


ডিসেম্বর ২৫, ২০২১
০১:৪৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ২৫, ২০২১
০১:৪৫ পূর্বাহ্ন



স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে ঝাঁপ দেন তিনি, বড় মেয়ে তখনও লঞ্চে

রূপালী ব্যাংক লিমিটেড গুলশান করপোরেট শাখার ডিজিএম তাজউদ্দিন আহমদ স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন বরগুনা। চড়েছিলেন এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে। যে লঞ্চে গতকাল ভয়াবহ আগুনে ইতোমধ্যে ৪১ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। এরমধ্যে ঝালকাঠির জেলা হাসপাতাল মর্গে রয়েছে ৩৬ জনের লাশ। বেশিরভাগই পুড়ে গেছে। বিকৃত লাশ শনাক্ত করতে পারছেন না স্বজনরা। পাঁচ জনের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

যারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন তারা এখনও ভয়ঙ্কর স্মৃতি থেকে বের হতে পারেননি। ভয়াবহ এ আগুন থেকে বেঁচে ফেরা তাজউদ্দিন আহমেদের বড় মেয়ে তাহসীনা আহমেদ বলেন, ‘বেঁচে ফিরেছি বটে, কিন্তু নিজের মৃত্যু চোখের সামনে দেখে ফিরলাম।’

তাজউদ্দিন বলেন, ‘বরগুনার কাচচিড়া লঞ্চঘাট নামতাম আমরা। সঙ্গে স্ত্রী ফেরদৌস আরা আর দুই কন্যা তাহসীনা আহমেদ ও তাহীরা ফেরদৌস। তারা ছিল দোতলার কেবিনে। ফেরদৌস আরার ঘুম ভাঙে রাত সাড়ে তিনটার দিকে। তখন দেখেন লঞ্চের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে আগুন ছড়িয়েছে।

আগুন লেগে ইঞ্জিনও বন্ধ। লঞ্চ তখন সুগন্ধা নদীর মাঝখানে। ধোঁয়ার কারণে কিছুই দেখতে পারছিলেন না। তাই কেবিন থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়েই ছিলেন। যখন ধোঁয়ার কারণে আর থাকতে পারছিলেন না তখন বাধ্য হয়ে রেলিং ধরে ধরে এক তলায় নেমে আসেন।

সেখানে এসেও থাকতে পারছিলেন না। নিচে তাকালেন। ভীষণ স্রোত। মনে পড়লো, তার দুই মেয়ে সাঁতার জানে না।

তাজউদ্দিন আহমেদ তখন কেবল বলছিলেন, লঞ্চটা আরেকটু যাক, পাড় দেখা যাচ্ছে, কাছাকাছি গেলেই ঝাঁপ দেবো। এদিকে পর্যাপ্ত বয়া ছিল না। রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলছিল বয়া নিয়ে। তারপরও ভাগ্যক্রমে সেটা পেয়ে যান তাজউদ্দিন ও তার পরিবার। লঞ্চ কিছুটা এগোতেই বয়া নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেন স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে। বড় মেয়ে তখনও লঞ্চে।

তাজউদ্দিন বললেন, ‘পানিতে বয়া নিয়ে ছিলাম ১৫ থেকে ২০ মিনিট। শীতেই জমে যাচ্ছিলাম। ছোট মেয়েটা চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিল। বড় মেয়েটা রয়ে গেলো উপরে। আমি ভেবেছিলাম ছোট মেয়ে আর ওর মাকে রেখে আবার যাবো ওকে নিতে। নদীতে তখন স্রোত, ছোট মেয়েকে রেখে আমি আবার যাই মেয়েকে আনতে। কিন্তু স্রোতের কারণে এগোতে পারছিলাম না। এরপর লঞ্চ যখন পাড়ে আসে, তখন বড় মেয়ে তাহসিনাও ঝাঁপ দেয়।’

যারা তিনতলায় ছিলেন, তাদের বেশিরভাগেই নামতে পারেনি, অধিকাংশই মারা গেছেন আগুনে পুড়ে, বলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। আবার অনেকে নদীতে পড়ে মারা গেছেন।

লঞ্চে এত মৃত্যুর কারণ হিসেবে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকাকেই দায়ী করেন তিনি। বলেন, আগুন লাগতেই পারে, লঞ্চে রান্না হয়, গ্যাসও রয়েছে। কিন্তু আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি তো থাকতে হবে।

‘প্রথমে যখন আগুন লেগেছে, তখন যদি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যেত, তবে এত জন মরতো না। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে অনেককে দেখেছি হাল ছেড়ে দিতে। শেষের ১০-১৫ মিনিটেই পুরো লঞ্চে আগুন ছড়ায়। তখন বাজে পৌনে চারটা।

‘পাড়ে এসে কত লাশ যে দেখলাম। নদীতে যারা ঝাঁপ দিয়েছিল তাদেরও তোলা হয়েছে ততক্ষণে। চারদিকে আহাজারি।’ বললেন তাজউদ্দিন আহমেদ। তাহসীনার ভাষায়, ‘আমি তো একেবারে সামনাসামনি মৃত্যু দেখে এসেছি।’

আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী তাহসীনা আরও বলেন, ডিপ্রেশনে (বিষণ্নতা) গেলে আগে ভাবতাম, মরে গেলেই ভালো, আমরা অনেকেই এমনটা এটা ভাবি। কিন্তু চোখের সামনে দেখলাম মানুষ বাঁচার জন্য কীভাবে চিৎকার করছিল। এ চিৎকার ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি কানে হাত চেপে ধরে ছিলাম।’

তাহসীনা আরও জানান, ‘দোতলা-তিনতলায় আগুন জ্বলছে, আমি ছিলাম একতলায়। একতলায় তখন কেবল পাঁচ-ছয়জনের মতো। সবাই নেমে যাচ্ছে। আমি নামতে পারছি না। কারণ সাঁতার জানতাম না। আব্বুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আব্বুও আসতে পারছিল না।’

তাহসীনা বললেন, ‘আমার মনে পড়লো, ছোটবোনটাও সাঁতার জানে না। ওর কথাই বেশি ভাবছিলাম।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাহসীনার।

তাহসীনা বলেন, ‘ওখানেই বসেছিলাম। আশপাশে কেউ নেই। ওপরে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। এরপর যখন স্রোতের টানে টানে লঞ্চ নদীর পাড়ে আসে তখন আমি ঝাঁপ দেই।’

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন

এএফ/০২