স্বাধীনতার পথ দেখানো মাস্টার’দা সূর্য সেনের জন্মবার্ষিকী

সিলেট মিরর ডেস্ক


মার্চ ২২, ২০২২
০৬:৪৫ অপরাহ্ন


আপডেট : মার্চ ২২, ২০২২
০৬:৪৫ অপরাহ্ন



স্বাধীনতার পথ দেখানো মাস্টার’দা সূর্য সেনের জন্মবার্ষিকী

ব্রিটিশবিরোধী কিংবদন্তি বিপ্লবী মাস্টার’দা সূর্য সেনের জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে তার জন্ম। শুভ জন্মদিন, মাস্টার’দা সূর্য সেন!

বাবা রাজমণি সেন আর মা শশী বালা সেনের চতুর্থ সন্তান তিনি। ছোটবেলায় তার ডাকনাম রাখা হয় কালু।

মেধাবী শিক্ষার্থী সূর্য সেনের পড়াশোনা চট্টগ্রাম কলেজ ও মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কলেজে। ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বহরমপুর কলেজে তার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী। এই শিক্ষাগুরুর মাধ্যমে তিনি জীবনে প্রথম গোপন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে পরিচিত হন।

বিএ ডিগ্রি অর্জনের পর আর শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত করেননি সূর্য সেন। চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ান বাজার এলাকার উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।  দৃঢ় চরিত্রের জন্য তিনি সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেন। বিশেষ করে ছাত্ররা তার ভীষণ অনুরাগী হয়ে ওঠে। এলাকায় ‘‘মাস্টার’দা’’ নামে পরিচিতি পান।

১৯১৯ সালে তিনি কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের কন্যা পুষ্প কুন্তলার সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সংসার ধর্মের চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্ব পায় পরাধীনতা থেকে দেশের মুক্তি। শিক্ষকতা চলতে থাকে। সঙ্গে চলে গোপন বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ।

চট্টগ্রামের বিপ্লবী কর্মী অনুরূপ সেন, চারু বিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখের সঙ্গে গোপন বিপ্লবী দল গঠনের কাজে জড়িয়ে পড়েন মাস্টার’দা। প্রজ্ঞা আর দৃঢ়ভিত্তির নেতৃত্ব গুণে অল্প দিনেই তিনি দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। বিপ্লবী রাজনীতিতে পুরো সময় দেওয়ার জন্য এক পর্যায়ে ছেড়ে দেন শিক্ষকতা পেশা আর সংসার।

হঠাৎ করেই সশস্ত্র সংগ্রামের পথে হাঁটেননি মাস্টার’দা। ১৯২০ সালে গান্ধীজী কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তিনিও এতে যোগ দেন। গান্ধীজী ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়।

সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন আপসকামীতার রাজনীতিতে ব্রিটিশ রাজত্ব টলবে না। চাই অন্য কিছু। বাংলার বিপ্লবীরা তখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদল ‘‘অনুশীলন’’ এ। আরেক পক্ষ ‘‘যুগান্তর’’ এ। মাস্টার’দা সূর্য সেন যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে বিবাদমান দল দুটিকে একীভূত করার চেষ্টা করেন। ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজরা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এর প্রতিবাদে চট্টগ্রামে আয়োজিত সভায় বক্তৃতায় ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা রাখেন মাস্টার’দা। বিপ্লবী রিক্রুটে তার ছিল অনন্য গুণ।

সশস্ত্র সংগ্রামকেই সে সময়ের একমাত্র রাজনৈতিক পথ ধার্য করেন মাস্টার’দা। চলতে থাকে পরিকল্পনা, প্রস্তুতি। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল আসে সেই দিন। সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা যোগ দেন সশস্ত্র বিদ্রোহে। আগে থেকেই চট্টগ্রামমুখী রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়া হয়। এতে চট্টগ্রাম সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিপ্লবীদের আরেকটি একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। সব যন্ত্রপাতি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীর চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগারের কর্তৃত্ব নেয়।

এরপর পরিকল্পনা মাফিক গেরিলা কায়দায় দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক কব্জা করা হয়। বিপ্লবীরা পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে মাস্টার’দা সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি বক্তৃতায় বলেন, ‘ . . .The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood.’

সূর্য সেন নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা পুরো চট্টগ্রামকে সম্পূর্ণ রূপে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত রাখেন চার দিন। ব্রিটিশরাজের যেন ঘুম হারাম হয়ে যায়। সূর্য সেনকে আটকের জন্য দখলদার সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। একই বছরের ২৪ জুলাই ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শুরু করে।

কিন্তু সূর্য সেন থেমে ছিলেন না। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টার’দা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা সফল হয় না। উল্টো ইংরেজদের হাতে ১১ জন বিপ্লবী ধরা পড়েন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে মাস্টার’দা সূর্য সেনের অনুসারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান। তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

ধরা পড়ার আগেই সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী শহীদ নামে যিনি বহুল আলোচিত এক চরিত্র। মাস্টার’দা পটিয়ার কাছে গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেন। এক বিশ্বাসঘাতকের দেয়া সংবাদ মারফত ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গোর্খা সৈন্যরা স্থানটি ঘিরে ফেলে। সূর্যসেন ধরা পড়েন।

১৯৩৩ সালে সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার বসে। ১৪ অগাস্ট সূর্য সেনের ফাঁসির রায় হয়। এরপর ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।

ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে লিখে যান, “আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। তোমরা এগিয়ে চলো। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। যদি লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগে মৃত্যুর শীতল হাতে তোমাকেও স্পর্শ করে তবে আরাধ্য কাজের দায়িত্ব তোমার উত্তরসূরিদের হাতে অর্পণ করো।’’

সূর্য সেনকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানোর আগে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। তার সব দাঁত উপড়ে নেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তার অচেতন দেহ। তার মরদেহ নিয়ে পর্যন্ত আতঙ্কে ছিল ব্রিটিশরাজ। ১৫ মন পাথর বেঁধে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হয় তার নিথর দেহ।

কিন্তু মাস্টার’দার অবিনাশী চিন্তা গায়েব হয় না তাতে। ফিরে ফিরে আসেন তিনি শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিটি লড়াইয়ে প্রতিরোধের স্পৃহা হয়ে। হালের বলিউডও নতশিরে স্মরণ করে আমাদের চট্টলার এই সন্তানকে। একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার বিপ্লবী সক্রিয়তা অবলম্বনে। কিন্তু নিজ দেশে কতটা স্মরণ করা হচ্ছে মাস্টার’দাকে? কিছু নামকরণ আর ভাস্কর্য নির্মাণেই যেন সূর্য সেন শেষ।

সব জুলুমের রাজত্ব উড়িয়ে দিতে সূর্য সেনের সংগ্রাম এখনও প্রেরণার। এখানেই তার অনিবার্যতা। তার জন্মভূমি, রণক্ষেত্রসহ সকল স্মৃতির সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে মনে করি। এক নেতার এক ভাষণে এক দিনে আমাদের মাতৃভূমি শত্রু মুক্ত হয়নি এই সত্য মেনে নিতে সমস্যা কী? হাজার বছরের সংগ্রামে বাঙালি নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র পেয়েছে। বিপ্লবী সূর্য সেন ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত পর্বেরই এক নক্ষত্র।

আরসি-১৫