এলপিজির দামে নৈরাজ্য, ভোগান্তিতে গ্রাহক

নাওয়াজ মারজান


ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
০৭:৪৮ অপরাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩
০৮:৪০ অপরাহ্ন



এলপিজির দামে নৈরাজ্য, ভোগান্তিতে গ্রাহক
সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না • ৩০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে

ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সিলেটের গ্রাহকরা। গত বৃহস্পতিবার সরকারিভাবে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম এক লাফে ২৬৬ টাকা বাড়ালেও সেই দামেও কিনতে পারছেন না গ্রাহকরা। নির্ধারিত দামের চেয়ে তিনশ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। নগরের বিভিন্ন এলাকার গ্যাস বিক্রেতাদের ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

গতমাসে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত বৃহস্পতিবার সরকারিভাবে এর নতুন দাম ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা। ১ হাজার ৪৯৮ টাকার সিলিন্ডার সর্বনি¤œ ১ হাজার ৬৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে খুচরা ক্রেতাদের। গ্রাহকরা বলছেন সিলেটে এলপিজির দামে স্বেচ্ছাচারিতা করছেন ব্যবসায়ীরা।

এ ছাড়া সিলেটের বিভিন্ন বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব কোম্পানির সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে দাবি করছেন তাঁরা। এ জন্য খুচরা বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

সিলেট নগর ও শহরতলীতে যেসব ভবনে সরকারি কোম্পানি জালালাবাদ গ্যাসের সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাস লাইনের সংযোগ নেই, সেসব ভবনের বাসিন্দারা এলপিজি ব্যবহার করেন। শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলা ও গ্রামে বিপুলসংখ্যক মানুষ এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নিত্যপণ্যের সঙ্গে এলপিজির অতিরিক্ত দামে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে।

নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় ১ হাজার ৬৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার। জানুয়ারি মাসের জন্য প্রতি ১২ কেজি এলপিজির দাম ১ হাজার ২৩২ নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। তখনও ১২ কেজির প্রতি বোতল এলপিজি বিক্রি হয় ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায়।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা নেহার রঞ্জন জানান, গতমাসের মাঝামাঝি ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার ১ হাজার ৪৫০ টাকায় কিনেছেন তিনি। গতকাল দুপুরে একটি ১২ কেজির সিলিন্ডার যখন আনেন তখন তাকে গুণতে হয়েছে ১৬৫০ টাকা। সরকারিভাবে যে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তা কখনও মানা হয় না। এসব কাগজের নিয়ম-কানুন কাগজেই থেকে যায় বলে জানান তিনি।

এদিকে, গত দুই সপ্তাহ ধরে এলপি গ্যাসের বাজারে সংকট চলছিল। ১২ কেজির প্রতি সিলি২৬৬ টাকা দাম বাড়বে- এই সংবাদ আগাম জানতে পেরে বাজার থেকে গ্যাস সরিয়ে ফেলে কোম্পানিগুলো। এ সময় টাকা দিয়েও গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়নি। এমন অভিযোগ করেন নগরের কাজিরবাজার এলাকার এক খুচরা ব্যবসায়ী। ২ ফেব্রুয়ারি দাম বৃদ্ধির পর বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে জানান তিনি। কিন্তু তারপরও গ্যাস বিক্রি হচ্ছে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে।

সুরুজ মিয়া ফেরি করে সবজি বিক্রি করেন। নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাদারপাড়ায় পরিবার তিনি থাকেন। চার সদস্যের পরিবারে মাসে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার তার লাগে। সুরুজ মিয়া জানান, নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে পরিবার নিয়ে শহরে জীবন-যাপন করা কঠিন হয়ে পড়ছে তার জন্য। গতমাসে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার কিনেছিলেন ১ হাজার ৫৫০ টাকায়। দাম বাড়ায় একই সিলিন্ডার এ মাসে তাকে কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকায়। সুরুজ মিয়া বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সরকার আবারও বাড়িয়েছে। প্রতিমাসেই সবকিছুর দাম বাড়ছে। একমাসের চেয়ে আরেক মাসে এসে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এই চাপ নেওয়া কঠিন।

নগরের শেখঘাট এলাকার এক খুচরা এলপিজি বিক্রেতা জানান, সরকারিভাবে যে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এর থেকে বেশি দামে ডিলারদের কাছ থেকে তাদেরকেই কিনতে হয়। সঙ্গে আছে পরিবহণ খরচ। দোকান ভাড়া, কর্মচারির বেতনটাও তার হিসেবে রাখতে হয়। এরপর তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, মাস শেষে যদি কিছু টাকা আয়ই না হয় তাহলে ব্যবসা দিয়ে হবেটা কী?

২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে আসছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। প্রতিমাসে সরকারিভাবে বিইআরসি এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেয়। আগে সেই দাম যথেষ্ট হচ্ছে না বলে এলপিজি অপারেটররা বিরোধিতা করে। পরে বিইআরসি আরও এক দফা শুনানি করে অপারেটরদের মন রাখে। তখন অপারেটররা দাম ঠিক করে দেওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়। তবে সেই দামে গ্রাহক এলপিজি পায় না।

নগরের খোজারখলা এলাকার বাসিন্দা ওসমান বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, আমরা তো সে দামে পাচ্ছি না। দোকানিরা বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। সরকারিভাবে নির্ধারিত দামের কথা বললে, দোকানিরা বলেন, ‘হয় নেন, না হলে না নেন।’ এক্ষেত্রে আমরা এখন কী করব।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার খুচরা গ্যাস ব্যবসায়ী সুমন জানান, তিনি ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার ১৭০০ টাকা করে বিক্রি করছেন। দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ১৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করলেও তাদেরকে অতিরিক্ত মূল্যে কিনতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়েই বাড়তি মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি দাম বললে দোকানদারেরা অপমান করেন। তাঁরা বলেন সরকারের কাছ থেকে কিনতে। যদি দাম কার্যকর না-ই করবে, তাহলে নির্ধারণের মানে কী?

নগরের খোজারখলা এলাকার খাদিজা এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোম্পানি থেকেই তাদেরকে ১৫২০ টাকা দরে প্রতিটি এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে। এর মধ্যে তারা যমুনা ১৬০০ টাকা এবং বেক্সিমকো, ওমেরা ও বসুন্ধরা ১৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।

ভোক্তাদের অভিযোগ, গ্যাসের দাম বাড়াতে গত কয়েক মাস থেকে কৃত্রিম একটি সংকটের কথা বলা হচ্ছে। আর এই সংকটকে পুঁজি করে গ্যাসের দাম নিজেদের মতো করে বাড়াচ্ছেন বিক্রেতারা।
এলপিজির অতিরিক্ত দামের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট জেলার কর্মকর্তা মো. আমিরুল ইসলাম মাসুদ সিলেট মিররকে বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে যদি কোনো ভোক্তা কিনেন এবং প্রমাণসহ আমাদের কাছে আবেদন করেন, সেখানে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি। অভিযানকালে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এএনএম/০১