উৎমা ও তুরং ছড়া: কোম্পানীগঞ্জে পর্যটনে নতুন দুই সম্ভাবনা

কবির আহমদ, কোম্পানীগঞ্জ


সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩
০৬:৪৮ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩
০৬:৫০ অপরাহ্ন



উৎমা ও তুরং ছড়া: কোম্পানীগঞ্জে পর্যটনে নতুন দুই সম্ভাবনা
সড়ক যোগাযোগের বেহাল দশায় আগ্রহ নেই পর্যটকদের


প্রাকৃতিক নৈস্বর্গের লীলাভূমি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটকদের কাছে অতি পরিচিতি নাম। প্রতিদিন দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে। তবে সীমান্তবর্তী এ উপজেলায় পর্যটক টানতে সাদা পাথর ছাড়াও নতুন সম্ভাবনা হয়ে উঠছে  উৎমা ছড়া ও তুরং ছড়া নামে আরও দু'টি পর্যটন কেন্দ্র।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ধলাই সেতু দিয়ে পাহাড় ঘেঁষা একা বাকা মোটুপথে উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের উৎমা ছাড়া ও তুরং ছড়া গ্রামে গেলেই চোখ যতদূর যায়। ডানে, বামে ও সামনে সারি সারি উঁচু উঁচু সবুজ পাহাড়। এ পাহাড়ের বুকে গাঢ় সবুজের আস্তরণ। আকাশ যেনো হেলান দিয়ে আছে পাহাড়ের বুকে। পাহাড়ের বুক চিড়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে নেমে আসা ঝর্ণার শীতল স্বচ্ছ জলরাশি বয়ে চলছে সীমান্তবর্তী উৎমা ছড়া ও তুরং ছড়া নদ দিয়ে।

এ নদগুলোর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় বিভিন্ন রংয়ের অসংখ্য অগণিত পাথর। এ যেনো ছোট বড় পাথর ও স্বচ্ছ জ্বলের মিশ্রিত বিছানা।

সবুজ পাহাড় ঘেঁষা আকাশের নীলের ছায়া ও সাদা সাদা মেঘের খেলা। এমন এক সৌন্দর্য যা স্বচক্ষে না দেখলে বর্ণনা দিয়ে ভ্রমণ পিপাসুদের মনের পিপাসা মিটানো সম্ভব না। এ স্থানকে সিলেটের নতুন ‘পর্যটন কেন্দ্র’ বলে অভিহিত করে স্থানীয়রা ভ্রমণ করে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা করছে। তবে প্রশাসনের অবহেলায় সম্ভাবনাময়ী এই পর্যটন কেন্দ্র অচেনা থেকে যাচ্ছে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের কাছে।

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর থেকে উৎমাছড়ার দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। উৎমাছড়া থেকে তুরংছড়ার দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। তবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে এ দু'টি স্পটে যেত আগ্রহী নয় পর্যটকেরা। ভাঙ্গা-চোরা রাস্তা পাড়ি দিয়ে যারাই এ দু'টি ছড়ায় গিয়েছে  এখানের প্রকৃতি দেখে শত কষ্ট ভুলে আনন্দ ভ্রমণ করে সড়কপথে উন্নয়নের দাবী জানিয়েছেন। 


স্থানীয় ভ্রমণ পিপাসু ও পর্যটকদের দাবী রাস্তা ঘাটে বেহাল দশা ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সুনজর না লাগাই সম্ভাবনাময়ী এ পর্যটন কেন্দ্র গুলো মানুষের অজানাই থেকে যাচ্ছে। 

তবে আশার আলো হচ্ছে সীমান্তবর্তী উপজেলা গুলোর পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে সড়ক যোগাযোগ সহজ করার জন্য  কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর থেকে জাফলং পর্যন্ত সীমান্ত সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এই সড়ক নির্মাণ হলে ভোলাগঞ্জ সাদা, বিছনাকান্দি, জাফলং সহ এ দুই উপজেলার নতুন পুরাতন মিলে ২৩ টি পর্যটন কেন্দ্র খুনয়ি সহজেই ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকেরা। এ সড়কের আওতায় আসবে কোম্পানীগঞ্জ উৎমাছড়া ও তুরংছড়া।

সীমান্ত সড়ক নির্মাণ হলে অপরিমেয় সৌন্দর্যবিস্তৃতে কোম্পানীগঞ্জে আসবে কয়েক গুণ বেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে সমৃদ্ধ হবে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।

রূপ-লাবণ্যে যৌবনা উৎমাছড়া ও তুরংছড়া পরতে পরতে সাজিয়ে রেখেছে সম্মোহনী সৌন্দর্য। যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্ত নির্জন অরণ্যের সাহচার্য পেতে এই দুই ছড়ার বিকল্প নেই। আছে সবুজের সমারোহ, দিগন্ত বিস্তৃত সাদা মেঘের খেলা, পাথর ছড়ানো চারপাশ, দুধসাদা জলরাশি, পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশির কলতান, পাখির কিচিরমিচির। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই প্রকৃতি প্রেমীদের।

উৎমাছড়া ভ্রমণের শ্রেষ্ট সময় বর্ষাকাল। বছরের এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর মাসের যে কোন দিন উৎমাছড়া ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের সর্বোৎকৃষ্ট দিন।

প্রকৃতি কন্যা সিলেটের সৌন্দর্য্যটা আসলে বর্ষাকালেই বেশী উপভোগ করা যায়। আর তা ছাড়া বর্ষার সময়ে উৎমাছড়ার নদের স্বচ্ছ জ্বল, গাঢ় সবু্জের পাহাড় ও আকাশে মেঘের ছুটাছুটি এখানের সৌন্দর্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেয়।

দেশের ৬১ টি জেলা ভ্রমণকারী বাইকার ডাঃ আব্দুল আওয়াল দৈনিক সিলেট মিরর কে বলেন, আমি বাংলাদেশের ৬১টি জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ করেছি। সারা দেশের তুলানায় সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র গুলো একটু বেশি সুন্দর। তার মাঝে কোম্পানীগঞ্জের উৎমাছড়া ও তুরংছড়া একটু ভিন্ন রকম সুন্দর। পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশির ঝর্ণা পাথরের বুক বেদ করে উৎমাছড়া নদের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পাহাড় ও আকাশ একত্রে মিশে যায়, এ সৌন্দর্য আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, তা স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বুঝবেন না। তবে এই পর্যটন কেন্দ্রের প্রচার প্রচারণা না থাকায় ভ্রমণ পিপাসুরা এখানে আসে না। এই স্থানটিকে প্রচার-প্রচারণা করা হলে সিলেটের মধ্যে অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে এতে এই এলাকার মানুষের কিছু কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি সরকার বিপুল পরিমাণের রাজস্ব পাবে বলে আমি মনে করি।

স্থানীয় ভ্রমন প্রেমী বিজয় পাড়ুয়া গ্রামের সুমিত সিংহ জানান, উৎমাছড়া এলাকায় এক সময় পাথর কোয়ারি ছিল। এখানে হাজার হাজার শ্রমিক ব্যবসায়ীর কর্মসংস্থান ছিল। বর্তমানে এলাকার মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়ে দিশেহারা মানবেতর জীবন পার করছে। পাথর উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে হাইকোর্টের আদেশে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় উৎমাছড়া নতুন রূপে সেজেছে। স্থানীয় মানুষজন এখানে এসে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে আনন্দ উল্লাস করে। উৎমাছড়ার সৌন্দর্যের প্রচার-প্রচারণা করা হলে সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে ঘুরতে আসবে। সৌন্দর্যপূর্ণ এই স্থানকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোঘনা করা হলে পর্যটকদের আগমণে স্থানীয়দের কিছু কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমি মনে করি।

কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফি সোসাইটির সভাপতি শরীফ আহমদ জানান, উৎমাছড়ার অপরূপ সৌন্দর্যে স্থানীয় মানুষ মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণ করতে আসেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এখানে আসার প্রধান সড়ক কলাবাড়ী সেতু টু উৎমাছড়া বাজারের রাস্তা খুবই খারাপ থাকায় দূরদূরান্তের পর্যটকেরা আসতে পারে নাই। এ বছর স্থানীয় সাংসদ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদের বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা ব্যায়ে নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এখন প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যটন সংশ্লিষ্টদের প্রচার-প্রচারণায় এই স্থানটি হয়ে উঠতে পারে সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ার ফলে সিলেট সহ সারা দেশ থেকে আসা পর্যটকেরা সহজেই এই মনোমুগ্ধকর অপরূপ সৌন্দর্যপূর্ণ স্থানটি ভ্রমণ করতে পারবেন।

এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, উৎমাছড়া ও তুরংছড়া এলাকাটি অপরূপ সুন্দর। যা দেখলে যে কোন বয়সের মানুষের হৃদয়ে প্রশান্তি আসবে। উৎমাছড়ার সুন্দর্য উপভোগ করতে আমি গিয়েছি কয়েক বার। এই স্থানটি কে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে উপজেলা প্রশাসনের। সিলেট থেকে উৎমাছড়া যাওয়ার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে। উৎমাছড়া এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়াতে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষনার আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যেই বিজিবির একটি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিজিবির ক্যাম্পটি হয়ে যাবে। এটি হয়ে গেলেই উৎমাছড়া এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষনা করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রচার-প্রচারণা করা হবে। তিনি আরও বলেন, সিলেটের পর্যটনের উন্নয়নে ভোলাগঞ্জ টু জাফলং সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে কোম্পানীগঞ্জ ও গেয়াইনঘাটের পর্যটনের চিত্র যেমন পরিবর্তন হবে তেমনি ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অর্থনীতির পরিবর্তন হবে।


এএফ/০৮