সুপার এইট: জোড়া ম্যাচের কঠিন পথ বাংলাদেশের

আলী ওয়াসিকুজ্জামান চৌধুরী অনি


জুন ২০, ২০২৪
০৭:৪২ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ২১, ২০২৪
০৪:৪৩ অপরাহ্ন



সুপার এইট: জোড়া ম্যাচের কঠিন পথ বাংলাদেশের


প্রস্তুতি পর্ব থেকে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটে খেলবে-এমন আশা ক্রিকেটমোদীদের মধ্যে হয়তো ছিল, কিন্তু বাস্তবতা অনেক শঙ্কার মধ্যে ছিল সন্দেহ নেই। ক্রমাগত ব্যাটিং ব্যর্থতার বিপরীতে দলের বোলাররা দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দলকে তুলেছেন সুপার এইটে। ব্যাটিংয়ে সুবিধা না করতে পারলেও বাংলাদেশ বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে লড়াকু মনোভাব দেখিয়ে বিশ্বের ক্রিকেট বোদ্ধাদের মনযোগ কাড়তে বাধ্য করেছে। শান্ত ব্যাটিংয়ে ব্যার্থ হলেও অধিনায়কত্বের জন্য ফুল মার্কস পাচ্ছেন। 

বাংলাদেশ এই পর্বে পড়েছে এক নম্বর গ্রুপে যেখানে তাদের সঙ্গে আছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং আফগানিস্তান। বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান কেমন তা ক্রিকেটামোদী মাত্রই জানেন, তারা এটাও জানেন আফগানিস্তানও খুবই কঠিন প্রতিপক্ষ। তাই এ গ্রুপটি খুব কঠিন এবং প্রতিটি দলকে ঘাম ঝরিয়েই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করতে হবে। ঈদের ছুটির আমেজ শেষ হতে হতেই আমরা জেনে যাবো বাংলাদেশের অবস্থান। 

সুপার এইটের প্রথম ম্যাচ : বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ২১ তারিখ সকাল সাড়ে ছয়টায় ত্রিনিদাদের স্যার ভিভিয়ান রিচার্ড স্টেডিয়ামে। টি-টোয়েন্টিতে এই মাঠের প্রথম ইনিংসের এভারেজ স্কোর ১২০ আর দ্বিতীয় ইনিংসের ১০৩, আবার রান তাড়া করে জেতার পাল্লা সামান্য একটু ভারি। এই উইকেটে স্পিন বোলারদের সাফল্য একটু বেশি এবং একটু ধীরগতির হবার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া বিশ্বসেরা দলগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং ২০২১ সালের চ্যাম্পিয়ন।  বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিমধ্যে দশবার টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে তারা জয়ী হয়েছে ছয় বার। আক্রমনাত্মক ক্রিকেটের জন্য তাদের বিশ্বের সব দলই সমীহ করে। অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার যে কোন ফরমেটেই বিশ্বসেরাদের একজন। প্রচুর ফ্র‍্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলার কারণে বিশ্বের সব জায়গায় রান করার অভিজ্ঞতা আছে। এ বিশ্বকাপকে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন স্মরণীয় করে রাখতে। তার সঙ্গে ট্রাভিস হেড, অধিনায়ক মিচেল মার্শের সঙ্গে আছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অন্যতম সেরা মারকুটে ব্যাটার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল।

এছাড়া অলরাউন্ডার মার্কাস স্টোইনিস যে কেমন ব্যাট করেন তা এই বিশ্বকাপে ইতিমধ্যে আমরা দেখে ফেলেছি। এদের যে কেউ এই ম্যাচের গতিপথ ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। অস্ট্রেলিয়ার এ ব্যালান্সড ব্যাটিং বাংলাদেশের বোলারদের জন্য একটি বড় পরীক্ষা হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার বোলিং আক্রমণে প্যাট কামিন্স, মিচেল স্টারক, হ্যাজেলউড এর ফাস্ট বোলিং এবং এডাম জাম্পার লেগব্রেক বোলিং সামলানো যে কোনো দলের জন্য চ্যালেঞ্জিং। তাদের সঙ্গে মার্শ ও স্টোইনিসের বোলিংয়ের অপশন থাকায় অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোলিং ইউনিট তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ব্যাটারদের জন্য স্টার্ক, হ্যাজেলউড এবং জাম্পা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশ ও অস্টেলিয়ার মধ্যে পুর্বে খেলা ১০টি  টি-টোয়েন্টি ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে ৪টি এবং অস্ট্রেলিয়া জিতেছে ৬টিতে। এই ম্যাচে স্টোইনিস, ওয়ার্নার, ম্যাক্সওয়েল এবং স্টার্ক বড় ইম্প্যাক্ট রাখতে পারেন।   

সুপার এইটের দ্বিতীয় ম্যাচ: একদিন বিশ্রামের পর বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ২২ জুন রাত সাড়ে ৮টায় একই ভেন্যুতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিশ্বের সবচাইতে ভয়ংকর দল ভারতের। ইতিপূর্বে তাদের সাথে খেলা ১৩টি ম্যাচে বাংলাদেশ মাত্র একটি ম্যাচ জিতেছে, বাকি সবগুলোতেই ভারতের জয় হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে জমজমাট ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আইপিএল এ খেলে তাদের খেলোয়াড়রা এ খেলায় অনেক বেশী দক্ষ এতে কোন সন্দেহ নেই। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলী , রিশাভ পান্ট, সূর্যকুমার যাদব এর সাথে অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া, আক্সর প্যাটেল, শিভাম ডুবে আর রাভিন্দু জাদেজাদের সবাই তাদের ব্যাটিং দিয়ে লিখে দিতে পারেন ম্যাচের ভাগ্য। রোহিত শর্মা তার দিনে বিশ্বের যে কোন বোলিংকে তছনছ করে দিতে পারেন আর বিরাট কোহলী তাদের সেরা ব্যাটার যাকে সমীহ করে বিশ্বের সব বোলারই। এ দুজন ফর্মে না থাকলেও তারা বড় মঞ্চের খেলোয়াড়। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই চাইবেনা তাদের সাথে এরা ফর্মে ফিরে আসুক। বোলিং বিবেচনা করলে হার্ষদিপ সিং এর স্যুইং বোলিং বাংলাদেশের নড়বরে টপ অর্ডারকে মুশকিলে ফেলতে পারে। অভিজ্ঞ জসপ্রীত বুমরাহ এর গতি ও স্যুইং এর সাথে সিরাজ এবং হার্দিক এর ফাস্ট বোলিং বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। এদের সাথে অক্সর প্যাটেল ও রাভিন্দু জাদেজার বাহাতি স্পিন এমন উইকেটে হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর।  এ ম্যাচে তাই তারা ফেভারিট হিসেবেই মাঠে নামবে। আমি মনে করি রোহিত শর্মা , হার্ষদ্বিপ ও জাদেজা এই ম্যাচে বড় ইম্প্যাক্ট রাখবেন।  

বাংলাদেশ: এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না। দলের প্রথম তিন ব্যাটারদের মধ্যে অধিনায়ক শান্ত এখনও ব্যার্থ, তানজীদ ও লিটন দু’একটি ম্যাচে কিছু রান করলেও তাদের ধারাবাহিকতা একেবারেই নেই। যার ফলে অবধারিতভাবে মিডল অর্ডারের উপর চাপ পড়ছে এবং স্বাভাবিক খেলা ব্যহত হচ্ছে। তাওহিদ হৃদয়, মাহমুদুল্লাহ, সাকিব এর সাথে লোয়ার অর্ডারে জাকের আলী ও রিশাদ অল্পবিস্তর রান করেছেন কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে তা যথেষ্ট নয় বলেই মনে হয়েছে। তাই আশা করবো সুপার এইটের এই পর্বে এসে ব্যাটাররা তাদের সেরাটা দেবার চেষ্টা করবেন। প্রথম ম্যাচে এ অস্ট্রেলিয়া এবং পরের ম্যাচে ভারতের বোলিং সামলাতে তাদের আর বেশী ভালো খেলাটা প্রয়োজন তা তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তাদের বোলিং এর জন্য ফুলমার্ক্স পেয়েছে, মুলত বোলারদের কল্যানেই বাংলাদেশ সুপার এইতে উন্নিত হয়েছে। যে ধরনের উইকেটে খেলা হবে তাতে কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ, তরুন ফাস্ট বোলার তানজিম সাকিব আর অভিজ্ঞ ফাস্ট বোলার তাসকিনকে সামলানো যে কোন দলের পক্ষে কঠিন। মুস্তাফিজ ও তানজিম সাকিব আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। আর্লি ব্রেক থ্রু এনে দিতে তানজিম সাকিবের জুড়ি মেলা ভার। রিশাদের লেগ স্পিন বোলিং এর একটা ভালো স্পেল ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে পারে। তার টার্ন ও সাহসি বোলিং ইতিমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে সাবেক ক্রিকেট গ্রেটদের। বাংলাদেশের ক্রিকেটের আইকন সাকিব আল হাসান ধিরে ধিরে নিজেকে ফিরে পাচ্ছেন, সঠিক সময়ে আমরা নিশ্চয়ই এই চ্যাম্পিয়ান খেলোয়াড় এর স্বরূপ দেখতে পাবো। তার বাহাতি স্পিনে নীল হতে পারে দুই দলই। বাংলাদেশ এর তৌহিদ হৃদয়, মাহমুদুল্লাহ, সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজ ও তানজিম সাকিব এই ম্যাচ গুলোতে হতে পারেন ইম্প্যাক্ট রাখা খেলোয়াড়। 

বিশ্বের দুটি সেরা দলের সাথে এই দুটি খেলাতে বাংলাদেশ আন্ডারডগ এতে কোন সন্দেহ নেই তবে এরা অজেয় নয়। উভয় দলকে হারানর অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে, খেলোয়াড়েরা নিজেদের কাজ ঠিকঠাক কুরতে পারলে এই উইকেটে জয়ের হাসি বাংলাদেশের হতে পারে। হয়তো ফিরে আসতে পারে অস্ট্রেলিয়ার সাথে কার্ডিফ কিংবা ভারতের সাথে ফিরোজ শাহ কোটলার বিজয়ের মত আরেকটি উৎসবক্ষন। সারা  দেশের মানুষ সেই জয়ের উল্লাস করার জন্য অপেক্ষা করবে।

লেখক: ক্রিকেট বিশ্লেষক, সাবেক ক্রিকেটার, কোচ ও ক্রীড়া সংগঠক



এএফ/০৮