‘মিনিস্টার বাড়ি’ রক্ষার দাবিতে ফটকের সামনে মানববন্ধন, ভেতরে চলছে ভাঙার কাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট


অক্টোবর ২৫, ২০২৫
১১:২৮ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২৫, ২০২৫
১১:২৮ অপরাহ্ন



‘মিনিস্টার বাড়ি’ রক্ষার দাবিতে ফটকের সামনে মানববন্ধন, ভেতরে চলছে ভাঙার কাজ


সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ‘মিনিস্টার বাড়ি’ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের দাবি উঠেছে সিলেটজুড়ে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী বাড়ির বেদখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধারেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।

আজ শনিবার (১৫ অক্টোবর) দুপুরে মিনিস্টার বাড়ির ফটকে পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এসব দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে স্থপতিদের সংগঠন ‘ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক বাংলাদেশ’ (আইএবি) ও সেভ দ্য হেরিটেজ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মসূচিতে অংশ নেন।

‘মিনিস্টার বাড়ি’র প্রধান ফটকের সামনে যখন সিলেটের বিশিষ্টজন এটি রক্ষার দাবিতে মানববন্ধনে দাঁড়ান, তখনও প্রাচীরের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি ভাঙার শব্দ।

শুক্রবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাড়িটি পরিদর্শন করে রবিবার পর্যন্ত ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে বলেছিল। ওই নির্দেশনায় ওইদিন ভাঙার কাজ বন্ধ রাখা হলেও পরদিন অর্থাৎ আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির মূল ফটকে তালা মেরে বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে।

বাড়িটি রক্ষায় আয়োজিত মানববন্ধনে সূচনা বক্তব্য দেন ‘পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ’ সিলেটের ট্রাস্টি রেজাউল কিবরিয়া।

সেভ দ্য হেরিটেজের পক্ষে সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদীর সঞ্চালনায় দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, লেখক-সংগঠক সৈয়দ মনির হেলাল, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ (আইএবি) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি রাজন দাশ, সাংবাদিক আব্দুল কাদের তাপাদার, মুহিত চৌধুরী, সিলেট লেখিকা সংঘের সাধারণ সম্পাদক ইশরাক জাহান জেলী প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, ‘সিলেট যেমন প্রাকৃতিকভাবে সম্পদসমৃদ্ধ, তেমনি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়েও সমৃদ্ধ। অতীত ইতিহাস সুরক্ষিত থাকে স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে। এ অবস্থায় মিনিস্টার বাড়িটি নিশ্চিহ্ন হলে ইতিহাসের একটি প্রমাণ হারিয়ে যাবে।

’ তাঁরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে কেবল নির্দেশনা দিয়ে নয়, নিদর্শন হিসেবে ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এটি সংরক্ষণের আহ্বান জানান। পাশাপাশি আবদুল হামিদ মিনিস্টারের বেহাত হওয়া জমি পুনরুদ্ধারের দাবি জানান।

জমি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ (আইএবি) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক স্থপতি রাজন দাশ বলেন, ‘এই বাড়িটি জাতীয় স্মৃতি নিদর্শন, যা সংরক্ষণে কেবল প্রত্নতত্ত্ব আইন নয়, আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। বাড়ির সীমানাপ্রাচীর সিলেট সিটি করপোরেশন সড়ক বর্ধিত করতে ভেঙেছিল। সেটি পুনঃস্থাপন করা হয়নি।

এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগও বেশ কিছু জায়গা বিনা অধিগ্রহণে ব্যবহার করছে। এসব জায়গা পুনরুদ্ধার করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা নিতে হবে।’

এদিকে ‘মিনিস্টার বাড়ি’ সংরক্ষণে সিলেট সিটি করপোরেশন বরাবর রবিবার (২৬ অক্টোবর) স্মারকলিপি দেওয়ার বিষয়টি অবহিত করে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলা মানববন্ধন সমাপ্ত করা হয়।

মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভির হাসান, সুব্রত দাশ, উন্নয়নকর্মী মেহাম্মদ আজিজুর রহমান, রাজনীতিবিদ রেজাউল করিম আলো, যুব ইউনিয়ন নেতা অ্যাড. মতিউর রহমান, মদিনা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক কোষাধ্যক্ষ আব্দুল জব্বার শাহী, অনলাইন প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মুহিত চৌধুরী, ‘ভয়েস টোয়েন্টিফোর’-এর কনটেন্ট ক্রিয়েটর আবদুর রহমান হীরা, স্থপতি কল্লল চন্দ শান্ত, স্থপতি রেজওয়ান আহমেদ সামি, স্থপতি মারিয়াম চৌধুরী, স্থপতি রাবেয়া বসরি রিফাত, স্থপতি শাহ মো. হাছিন শাদ, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্যের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম ও শেওতি আলম।

এর আগে শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সরেজমিন গিয়ে বাড়িটি ভাঙার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিদর্শনে গবেষণা সহকারী মোহাম্মদ ওমর ফারুক। ওই নির্দেশনার পরদিন শনিবার থেকে ভাঙার কাজ শুরু হয়। ভাঙার কাজের দায়িত্বে থাকা ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মহরম আলী জানান, তিনি বাড়িটি ভাঙার জন্য ভাঙ্গারির দরে ১৮ লাখ টাকায় কিনেছেন।

প্রসঙ্গত, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ও সুপরিচিত ‘মিনিস্টার বাড়ি’ চুন-সুরকির ছাদওয়ালা ‘লেট-ব্রিটিশ’ স্থাপত্যশৈলীর। বাড়িটির মালিক ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের আসামের মন্ত্রী আবদুল হামিদ। প্রায় ৯৫ বছর টিকে থাকা এই আসাম স্মৃতির নিদর্শনটি এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে।

ইতিহাস ঘেটে জানা গেছে, বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আবদুল হামিদ। তিনি ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। সেই সূত্রে বাড়িটি ‘মিনিস্টার বাড়ি’ নামে পরিচিতি পায়। এই বাড়িতে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন তৎকালীন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। 

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে এই বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। মিনিস্টার আবদুল হামিদ তাঁর দাদা ছিলেন।



এএফ/০১