আবার মৃত্যু, বাড়ছে আতঙ্ক

নিজস্ব প্রতিবেদক


এপ্রিল ১৬, ২০২০
০৭:১২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৬, ২০২০
০৭:৫৬ পূর্বাহ্ন



আবার মৃত্যু, বাড়ছে আতঙ্ক
সিলেটে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি

‘ফেসবুকে তাঁর ছবিটা দেখলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। হায় গড, এ কেমন মৃত্যু! ওপার থেকে কার কখন ডাক পড়ে কে জানে?’ করোনা-আক্রান্ত হয়ে সদ্য প্রয়াত চিকিৎসক মো. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুতে হতাশা প্রকাশ করে ফেসবুকে এ স্ট্যাটাস দেন সিলেটের ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক পার্থ তালুকদার। তাঁর মতো সিলেটের অনেক বাসিন্দা এখন ভড়কে গেছেন, আছেন ভীতিতে। গত ৪ এপ্রিলের পর করোনা-আক্রান্ত হয়ে গতকাল আরেকজনের মৃত্যুর ঘটনায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এমন পরিস্থিতিতে কেউ যেন মনোবল না হারান, চিকিৎসকেরা এমনটাই পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারও আহ্বান জানানো হয়।

গতকাল বুধবার ভোর ৬টা ৪৫ মিনিটে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপকও সিলেট নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকার বাসিন্দা মো. মঈনউদ্দিন (৪৭) রাজধানীর কুর্মিটুলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের মারা যাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। এরআগে গত ৫ এপ্রিল তিনি করোনা-আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন। গতকাল মঈন উদ্দিনের শোক কাটিয়ে উঠার আগেই দুপুরে খবর আসে, সুনামগঞ্জের বাসিন্দা ও নারায়ণগঞ্জে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়ক ও উপপরিচালক গৌতম রায়ের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের দুজন নারী ও হবিগঞ্জের এক ব্যক্তির শরীরেও এর আগে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। অন্যদিকে গত ৫ এপ্রিল মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার টেংরা ইউনিয়নের আকুয়া গ্রামের এক ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। যদিও করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসার আগেরদিনই ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়।

সিলেটে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে এরই মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারকে ‘লকডাউন’ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। অন্যদিকে হবিগঞ্জ জেলাকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে ‘বিচ্ছিন্ন’ রাখার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ পরিস্থিতিতে সিলেট বিভাগের চার জেলা জুড়েই সাধারণ মানুষ অনেকটা আতঙ্ক আর ভয়েই রয়েছেন। স্থানীয়দের মারফত জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে জ্বর, সর্দি ও কাশির লক্ষ্মণ নিয়েও সিলেটে বেশ কয়েক জন ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তবে প্রশাসন বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত লক্ষণ নিয়ে তাঁদের মৃত্যু হয়নি। এলাকাবাসী ভয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুকেও করোনোভাইরাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের উত্তর রায়গড় গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব আজির উদ্দিন নামের এক বৃদ্ধ নিজ বাড়িতে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি কয়েকদিন ধরে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শাহিনূর ইসলাম জানান, বেলা একটায় আজির উদ্দিনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।নমুনা সিলেটে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য স্থাপিত গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে, ওই বৃদ্ধ করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা। তবে প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত তাঁর পরিবারের সদস্যদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে স্থাপিত ল্যাবে গত ৭ এপ্রিল থেকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে ৫৭১টি নমুনা পরীক্ষা হয়। এর মধ্যে দুজনের মধ্যে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। এঁরা দুজনই সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। এর বাইরে ঢাকা আইইডিসিআরের ল্যাবে সিলেট বিভাগের তিনজনের শরীরে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সিলেটে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় সচেতন বাসিন্দারা। তাঁদের ভাষ্য, লকডাউন ঘোষণা করা হলেও এখনও মানুষজন দেদারসে বাসার বাইরে বেরোচ্ছেন। পাড়া-মহল্লায় ক্লাবগুলোতে চলছে আড্ডা। হাটবাজারে মানুষের ভিড়। বিশেষ করে নগরের কালীঘাট ও মহাজনপট্টি এলাকার পাইকারি বাজারে মানুষের ভিড় বেশি বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। জনসমাগম এড়াতে না পারলে করোনোভাইরাসের বিস্তারের ঝুঁকিতে পুরো সিলেট পড়তে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এ অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর অবস্থানে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন সচেতন বাসিন্দারা।

সিলেট নগরের শেখঘাট এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান সিলেট মিররকে বলেন, ‘সিলেট এমনিতেই প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। গত এক মাসের ব্যবধানে অনেক প্রবাসী সিলেটে এসেছেন। এ ছাড়া বৃহত্তর সিলেটের গ্রামাঞ্চলে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় গার্মেন্টেসে কাজ করেন, এমন অনেক শ্রমিক বাড়িতে ফিরেছেন। ফলে সিলেট করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।’এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে সবাইকে ঘরের ভেতরে অবস্থান করা উচিত। পাশাপাশি বারবার হাত ধুয়া উচিত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেই একজন ব্যক্তি করোনাভাইরাস এড়াতে পারবেন।