বড়লেখার কর্মহীন মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন তারা

এ.জে লাভলু, বড়লেখা


মে ২০, ২০২০
০৫:০১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ২০, ২০২০
০৫:০১ পূর্বাহ্ন



বড়লেখার কর্মহীন মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন তারা

একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা তানিয়া (ছদ্মনাম)। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার এলাকায় তাঁর বাড়ি। করোনা পরিস্থিতির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছিলেন না তিনি। তাই উপার্জনের পথ বন্ধ। ঘরে থাকা খাবারও ফুরিয়ে গেছে। টাকার অভাবে তিনি খাবার কিনতে পারছিলেন না। নিজের এ অসহায়ত্বের কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারছিলেন না। হঠাৎ ফেসবুকে ‘করোনা মহামারিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পাশে আসুন (বড়লেখা)’ নামের একটি গ্রুপ তাঁর চোখে পড়ে। নিরুপায় হয়ে তানিয়া ওই গ্রুপে ঢুকে তাতে উল্লেখ থাকা একটি নম্বরে কল দেন। গ্রুপের এডমিনকে ফোনে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানান। এর পরই কয়েকজন তরুণ ওই শিক্ষিকার বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হাজির হন। খাবার পেয়ে ভীষণ খুশি হন তানিয়া।

জামিলের (ছদ্মনাম) বাড়ি উপজেলার নিজবাহাদুরপুর ইউনিয়নে। প্রায় দুইমাস আগে গ্রীসে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনের কারণে তাঁর কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। আয়-রোজগার একেবারেই নেই। তাই তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। এতে জামিলের পরিবারও খাবার কিনতে পারছিল না। পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারছিলেন না। এ অবস্থায় জামিল কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিনি ফেসবুকে ঢুকে দেখেন ‘করোনা মহামারিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পাশে আসুন (বড়লেখা)’ নামের একটি গ্রুপে থাকা ফোন নম্বরে কল করলে খাদ্যসামগ্রী বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এরপর জামিল ওই গ্রুপে থাকা একটি নম্বরে কল করে গ্রুপের এডমিনকে নিজের সমস্যার কথা জানান। এর পরই কয়েকজন তরুণ জামিলের বাড়িতে খাবার নিয়ে হাজির হন। এতে হাসি ফুটে ওঠে জামিলের পরিবারের সদস্যদের মুখে।

শুধু শিক্ষক তানিয়া বা প্রবাসী জামিল নন, এভাবে দেশ-বিদেশে থাকা কর্মহীন অনেক মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছেন একদল তরুণ। তাদের সবাই বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। তারা গত দেড় মাসে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রায় ৪০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। পাশাপাশি তারা কোনো কোনো ব্যক্তিকে ওষুধ ও মৃত ব্যক্তির জন্য কাফনের কাপড়েরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে তারা এসব মানুষের নাম-পরিচয় প্রকাশ করছেন না।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে চলছে লকডাউন। এতে মানুষ গৃহবন্দি। এই পরিস্থিতিতে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গরিব মানুষের পাশাপাশি সংকটে পড়েছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার। তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা কাউকে বলতে পারছেন না। এতে তাদের অনেককে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।

এসব মানুষের কথা ভেবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সম্প্রতি ‘বড়লেখা ছাত্রকল্যাণ সংঘ সিলেট’র কয়েকজন শিক্ষার্থী উদ্যোগ নেন। এজন্য শুরুতেই তাঁরা ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলেন, যার নাম দেন ‘করোনা মহামারিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পাশে আসুন (বড়লেখা)’। এতে জুড়ে দেন ৩টি মুঠোফোন নম্বর। যাতে মানুষ সহজে মুঠোফোনে তাদের কাছে খাদ্য সহায়তা চাইতে পারেন। এতে দেশ-বিদেশে থাকা অনেকেই তাদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করছেন।

ফেসবুকে তাদের কার্যক্রম দেখে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১৫০ জন তরুণ স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন। যেসব পরিবার তাদের কল দিয়ে অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছেন, তাদের ঘরে মোটরসাইকেল দিয়ে তারা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।

তারা জানান, এ পর্যন্ত ৪০০ পরিবারকে চাল, ডাল, আলু, তেল, আটা, পেঁয়াজ, লবণ, সাবান, খাবার ও মাছসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী দিয়েছেন। পাশাপাশি ৪টি পরিবারকে ওষুধ ও দু'জন মৃত ব্যক্তির কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থা করেছেন।

গ্রপের প্রধান এডমিন ও বড়লেখা ছাত্রকল্যাণ সংঘ সিলেট’র সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম বাবু বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব থমকে গেছে। মানুষজন ঘরবন্দি। তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বেশি সংকটে পড়েছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। কাজকর্ম না থাকায় অনেকে খাবার সংকটে পড়েছেন। তারা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। এজন্য কেউই তাদের কষ্ট বুঝতে পারছেন না। মূলত এসব মানুষের কথা ভেবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিই। এজন্য শুরুতেই একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে তাতে ৩টি ফোন নম্বর দেই। এরপর থেকে বেশিরভাগ মানুষ খাদ্যের জন্য ফোন দিয়েছেন। এছাড়া কেউ কেউ ওষুধের জন্য ও মৃত ব্যক্তির কাফনের কাপড়ের জন্যও ফোন দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ফেসবুকে আমাদের কার্যক্রম দেখে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ১৫০ জন তরুণ স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন। যেসব পরিবার আমাদের কল দিয়ে অসহায়ত্বের কথা জানাচ্ছেন, মূলত তাদের ঘরে মোটরসাইকেল দিয়ে খাবার পৌঁছে দিতে সহযোগিতা করছেন তারা।

কামরুল ইসলাম বাবু আরও বলেন, দেশ-বিদেশে থাকা শত শত মানুষ ফেসবুকে ও বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরে প্রতিদিন আমাদেরকে কল দিচ্ছেন। দেশ-বিদেশে থাকা অনেকের আর্থিক সহায়তায় আমরা এ পর্যন্ত ৪০০ পরিবারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী দিয়েছি। এতে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে। পাশাপাশি প্রত্যন্ত এলাকার চারজনের বাড়িতে ওষুধ ও দু'জন মৃত ব্যক্তির জন্য কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থা করেছি। অবশ্য যাদের আমরা সহায়তা করছি, তাদের সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে নাম-পরিচয় গোপন রাখছি। করোনাভাইরাস যতদিন থাকবে, ততদিন আমাদের এ কার্যক্রম চলবে। এজন্য কেউ চাইলে আমাদের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবেন। এতে করে আমরা আরও বেশি মানুষকে সহায়তা দিতে পারব।

 

এজে/আরআর-১০