মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী, দোয়ারাবাজার
জুলাই ১০, ২০২০
১২:১৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুলাই ১০, ২০২০
১২:১৮ পূর্বাহ্ন
সাম্প্রতিক বন্যায় কপাল পুড়েছে সুনামগঞ্জের ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার মৎস্যচাষীদের। বানের পানিতে ভেসে গেছে তাদের কয়েক কোটি টাকার মাছ। পথে বসার উপক্রম হয়েছে এখন খামারিদের। নতুন করে পোনা ছেড়ে চাষ করার সুযোগও নেই। ব্যাপকভাবে পুকুরগুলো তলিয়ে গিয়ে বানের পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন এখানকার মৎস্যচাষীরা। বর্তমানে পানি নেমে গেলেও পোনা মাছের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের সফল মৎস্যচাষী আব্দুস শহীদ। ১৭টি দিঘি ও পুকুর নিয়ে আশপাশের এলাকার মধ্যে সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক মৎস্য খামার তার। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকি ১৬টিই তলিয়ে গেছে বন্যায়। খামারে ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। পোনা মাছ ছাড়াও বেশ কয়েকটিতে ২ বছরের পুরোনো বড় মাছও মজুদ ছিল। আকস্মিক বন্যায় প্রায় দেড় কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে পানিতে। পুঁজি হারিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
একই গ্রামের সফল মৎস্যচাষী আব্দুর রহিম। তিনি দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে মৎস্য চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বছর তিনেক আগে জেলা প্রশাসন কর্তৃক জেলার শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষীর পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি। বাড়ির পাশেই ৪০ বিঘা জমির একটি বড় পুকুরসহ আরও বড় ও মাঝারি সর্বমোট ৫টি পুকুর নিয়ে তার বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। সবক'টিতেই পুরোনো মাছ মজুদ ছিল। এবার বন্যায় শুধু পুকুর তলিয়ে মাছ যায়নি, বন্যার পানির স্রোতের বেগে একাধিক পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে তার প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকার মাছ।
একই ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী টেংরাটিলা গ্রামের মৎস্যচাষী শের মাহমুদ ভুঁইয়া। ৪০ একর জমির একটি বিশাল দিঘি খনন করে দিঘিটিতে এবারই প্রথম শুরু করেছিলেন বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ। দিঘি ছাড়াও ছোট-বড় মিলিয়ে আরও ৪টি পুকুর রয়েছে তার। এবারের আকস্মিক বন্যায় দিঘিসহ তার সবক'টি পুকুর তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকার মাছ।
একই গ্রামের মৎস্যচাষী তাজুল ইসলাম। ছোট-বড় ৭টি পুকুর নিয়ে তার বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। প্রত্যেকটি পুকুরেই মজুদ ছিল বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন জাতের মাছ। বন্যায় তারও সবক'টি পুকুর তলিয়ে গেছে। নেট দিয়েও আটকে রাখা যায়নি মাছ। বানের পানিতে ভেসে গেছে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকার মাছ।
একই ইউনিয়নের মহব্বতপুর, বরকতনগর, টিলাগাঁও, গিরিশনগর, শান্তিপুরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার পুকুরগুলো তলিয়ে গিয়ে লাখ লাখ টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের লামাসানিয়া গ্রামের খামারি হেলাল উদ্দিন, হাজী আবদুল হান্নান, সাবেক ইউপি সদস্য ফরিদ মিয়া, নজরুল ইসলাম, ডা. হারিছ মিয়া, মুজিবুর রহমান, জাকির হোসেন, জজ মিয়া, দলেরগাঁও গ্রামের কালামিয়া, রবীন্দ্র চৌধুরীসহ পরমেশ্বরীপুর, বীরসিংহ ও টেবলাই গ্রামের প্রায় প্রতিটি খামারের লাখ লাখ টাকার মাছ বানের পানিতে ভেসে গেছে।
এদিকে পার্শ্ববর্তী ছাতক উপজেলার নোয়ারাই ইউনিয়নের গোদাবাড়ি গ্রামের মৎস্য খামারি ডা. আবদুল মোমিনের দেড়শ বিঘার ৪টি পুকুরের প্রায় ১ কোটি টাকার মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। একইভাবে ওই ইউনিয়নের মানিকপুর, রংপুর, ছনখাইড়, রাজারগাঁও, চানপুর, কছুদাইড় ও বেতুরা গ্রামের অসংখ্য পুকুরের লাখ লাখ টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে মৎস্যচাষীদের করুণ দশার খবর জানা গেছে। বানের পানিতে ভেসে গেছে খামারিদের অন্তত কয়েক কোটি টাকার মাছ। দিঘি-পুকুরে বিনিয়োগকৃত শ্রম, ঘাম ও পুঁজি বানের জলে এক নিমিষে হারিয়ে উপজেলার মৎস্যচাষীরা এখন দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন। অনেকের কাঁধে ঋণের বোঝা।
মৎস্যচাষীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় কোনো ধরণের আগাম প্রস্তুতিই নিতে পারেননি তারা। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই এবারই প্রথম আকস্মিক বন্যায় একযোগে সব মৎস্য খামার তলিয়ে গেছে। বন্যার পানির স্রোতের বেগের কারণে জাল দিয়ে ঘেরাও করেও মাছ আটকানো যায়নি। অনেক পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। করোনা পরিস্থিতি ও বন্যা, সবমিলিয়ে এখন পুঁজিশূন্য হয়ে পড়েছেন উপজেলার মৎস্যচাষীরা।
উপজেলার মৎস্য খাদ্যের ডিলার ও ব্যবসায়ী কাজী মনিরুজ্জামান সিলেট মিররকে বলেন, 'এলাকার বেশিরভাগ মৎস্য খামারের মাছের খাদ্যের সরবরাহ করি আমি। কোম্পানির কাছ থেকে বাকিতে খাদ্য এনে মাছচাষীদের কাছে বিক্রি করি। মাছ বড় করে বাজারজাত করার পর মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে আমার খাদ্যের টাকা পরিশোধ করেন মাছচাষীরা। বছর শেষে কোম্পানিকেও আমার সকল পাওনা টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এবার করোনা ও আকস্মিক বন্যায় মাছচাষীরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হননি, আমরা যারা মাছের খাদ্য সরবরাহ করে থাকি তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এলাকা ও এলাকার বাইরের মাছচাষীদের কাছে আমার এখনও প্রায় দেড় কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।'
দোয়ারাবাজার উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা তুষার কান্তি বর্মণ বলেন, 'উপজেলার মৎস্যচাষীরা এবার ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। বন্যা পরবর্তীতে মৎস্যচাষীদের খোঁজ-খবর নিয়েছি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ এখনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষীরা সরকারি প্রণোদনার জন্য আবেদন করলে তাদের উপজেলা মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে সবধরণের সহযোগিতা করা হবে।'
এইচএইচ/আরআর-০৬