সিলেটে বাড়ছে উদ্যোক্তা

রাফিদ চৌধুরী


জুলাই ১০, ২০২০
১১:২৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১১, ২০২০
০২:৫৭ পূর্বাহ্ন



সিলেটে বাড়ছে উদ্যোক্তা
তরুণদের বড় অংশই ঝুঁকছেন অনলাইন ব্যবসায়

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সারাদেশের মতো সিলেটেও ব্যবসা-বাণিজ্যে ধ্বস নেমেছে। সংকুচিত হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকা-। ফলে একদিকে কর্মীরা চাকরি হারাচ্ছেন, অপরদিকে পুুঁজি হারাচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। যদিও এর বিপরীত চিত্র অনলাইন ব্যবসায়। করোনাকালে ঘরে বসে পণ্য পেতে ক্রেতাদের যেমন অনলাইনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে, তেমনি অনলাইনের ব্যবসায় তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। স্বল্প পুুঁজিতে ব্যবসার সুযোগ থাকায় সিলেটে বাড়ছে অনলাইন উদ্যোক্তা। 

প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের তরুণরা একসময় ছিলেন ইউরোপমুখী। জুটেছে কোনো কিছু করতে না পারার অপবাদও। এখন তরুণদের বিদেশ যাত্রার ঝোঁক কিছুটা কমেছে। পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে গেলেও অনেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরছেন। হচ্ছেন উদ্যোক্তা। শুধু বিদেশ ফেরতরাই নন, দেশে পড়াশোনা শেষ করেও অনেকে চাকরির অপেক্ষায় না থেকে হচ্ছেন উদ্যোক্তা। করোনাকালে সিলেটে উদ্যোক্তার সংখ্যা আরও বেড়েছে। ‘ঘরে বসে বাজার’ ধারণাও সাড়া পেয়েছে মহামারীর এই সময়ে। কাঁচাবাজার ও মাছ মাংস কেনার জন্যও এখন মানুষজন অনলাইন শপের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

করোনা সংক্রমণের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। দেশব্যাপী লকডাউনে অচল হয়ে যায় প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-। করোনাভীতির কারণে অনেকেই তখন সাহস করে বাজারে যেতে পারছিলেন না। তখন মানুষজন বিকল্প মাধ্যম খুঁজে নেন। আগে থেকেই ই-কমার্স ব্যবসা শুরু হলেও করোনাকালে এই ব্যবসা আরও জমে উঠে। সিলেটের নতুন নতুন উদ্যোক্তা অনলাইনে ব্যবসায় নামেন।  

‘সিলেট বাজার সদাই’ সেই বিকল্প মাধ্যমের একটি। সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কয়েকজন তরুণ মিলে শুরু করেন ‘সিলেট বাজার সদাই’ এর কার্যক্রম। অনলাইনে অর্ডার নিয়ে মানুষের ঘরে বাজার পৌঁছে দেন তারা। প্রতিটি অর্ডারের জন্য পণ্য অনুযায়ী ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে ডেলিভারি চার্জ নেন তারা। 

আশিক আহমেদ চৌধুরী সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুদিন আগে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এখন তিনি ‘সিলেট বাজার সদাই’ এর সহ প্রতিষ্ঠাতা। আশিক আহমেদ সিলেট মিররকে বলেন, ‘সবাই যখন ঘরে বসে দিন পার করছিলেন তখনই আমরা এই কার্যক্রম শুরু করি। মাত্র দুই মাস হলো আমরা যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু এর মধ্যেই যতটুকু সাড়া পেয়েছি, তা প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’ 

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সব পেশার লোকজন আমাদের সেবা গ্রহণ করছেন। সবার কাছে ভালো মানের পণ্য পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য। সেজন্য দিনের যে সময় টাটকা পণ্য পাওয়া যায়, সেই সময়েই আমরা পণ্যের অর্ডার গ্রহণ করি। অন্যথায় নয়।’

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মাছ এবং সবজি টাটকা পাওয়া যায় সকালবেলা। দুপুর গড়িয়ে গেলেই মাছ আর টাটকা পাওয়া যায় না। তাই মাছের অর্ডার সকাল ছাড়া আমরা নেই না।’

করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে কুরিয়ার থেকে পণ্য গ্রহণ করতে ভরসা পান না। আবার নির্ধারিত সময়ে পণ্য গ্রহণ না করলেও সেটা ফিরেও যায়। এই ক্ষেত্রেও বিকল্প মাধ্যম নিয়ে এসেছে ‘সিলেট বাজার সদাই’।   

অনলাইন বাজার সদাইয়ের অন্য প্রতিষ্ঠান ‘কিলাগবে এক্সওয়াইজেড’। শাক-সবজি, মাছ থেকে শুরু করে ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যসামগ্রী রয়েছে তাদের কাছে। রয়েছে তাদের নিজস্ব গুদাম ঘরও। ফেসবুকে তাদের পরিচিতি বেশি, রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইটও। তাদের কার্যক্রম করোনাকালের বহু আগে শুরু হলেও করোনাকালে তারা সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির সহ প্রতিষ্ঠাতা মো. জাকির হোসেন সিলেট মিররকে বলেন, ‘দুই বছর আগে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। শুরুতে তো এই ধারণা অনেকের কাছে নতুন ছিল। তাই মানুষের সাড়া পেতে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে মানুষের চাহিদা বেড়েছে। করোনাকালে এই চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। 

তিনি বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সবাই ঘরে বসে সবকিছু পেতে চান। একজন মানুষ সারাদিন অফিস করে এসে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বাজার যেতেও পারছেন না। সেক্ষেত্রে তিনি অনলাইনে বাজারের সহযোগিতা নিতে পারেন। সেই চিন্তা থেকেই আমাদের এই উদ্যোগ।’ 

একই ধরনের প্রতিষ্ঠান ‘দেশিয়ানা ডট কম’। তাদের কাছেও রয়েছে সবজি, মাছ-মাংস এবং আরও অনেক পণ্য। যেগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে তারা কোনো ডেলিভারি চার্জ নেন না। নগরের অভ্যন্তরে বিনামূল্যে ডেলিভারি দিচ্ছেন তারা। 

‘সিলেটের তরুণ প্রজন্ম কিছু করতে পারে না’- এই অপবাদ ঘোচাতে চায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘চপ্পারি আও’। এমনটি জানালেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা আদনান খান। সিলেট মিররকে তিনি বলেন, ‘অনলাইনের বাজারকে আরও সমৃদ্ধ করাই আমাদের লক্ষ্য।’

করোনাকালে অনলাইনেই বাজার করেন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ইইই বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক নওশাদ আহমেদ চৌধুরী। তিনি সিলেট মিররকে বলেন, ‘অনলাইনে অনেকের কাছ থেকেই আমি বাজার করেছি। মহামারী শুরুর পর থেকে শাক-সবজি, মাছ-মাংস অনলাইনেই কিনছি। তাদের পণ্য ও সেবার মান অনেক ভালো।’ 

অনলাইনে ব্যবসায় কিছু প্রতিষ্ঠান ডেলিভারি চার্জ নিলেও অনেকে ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই পণ্য পৌঁছে দেন। নির্দিষ্ট পরিমান পণ্য কিনলেও অনেকে ফ্রি ডেলিভারি দিচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইতে চাইলে ‘সিলেট বাজার সদাই’ এর সহ প্রতিষ্ঠাতা আশিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘ডেলিভারি কেউই ফ্রিতে দেয় না। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সেটা পুষিয়ে নেয়। আমরা বাজার থেকে একটা সাবান কিনলেও সরকারকে কর দেই। পণ্যের মূল্যের মধ্যেই সেই কর ধরা আছে। ঠিক একই রকম ডেলিভারি চার্জের বেলাতেও। অনেবে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে ডেলিভারি চার্জ পুষিয়ে নেয়।’

অনলাইনে এখন খাবার, ওষুধ, প্রসাধন সামগ্রী, কাপড় থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই কিনছেন ক্রেতারা। এই সুযোগেই সিলেটে ‘ডেলিভারি এক্সপ্রেস সিলেট’, নাদির’স শপ ও ‘কেয়ারবিডিকম’ এর মতো অনেক প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে গেছে। সিলেট নগরে ডেলিভারি চার্জ ৩০ টাকা, আর বাইরে ৫০ টাকা নিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। 

করোনাকালে সিলেটের তরুণ উদ্যোক্তাদের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কোষাধ্যক্ষ ফখর উস সালেহীন নাহিয়ান। সিলেট মিররকে তিনি বলেন, ‘মহামারীতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিলেটের তরুণ উদ্যোক্তারা। করোনার ঝুঁকির কারণে অনেকে এখন বাজারে যেতে ভরসা পাচ্ছেন না। যারা সচেতন তারা অনলাইনেই বাজার সারছেন।’ তবে এক্ষেত্রেও সচেতন থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। নাহিয়ান বলেন, ‘যেকোনো পণ্য ঘরে নেওয়ার আগে জীবাণুমুক্ত করা উচিত।’

সিলেটের তরুণরা এখন যুক্তরাজ্যমুখী না হয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিলেটের তরুণরা এখন আর বসে নেই। সবাই কিছু না কিছু করছেন। কাঁচা বাজারের পণ্য, মাছ-মাংস অনলাইনে চলে তারই প্রমাণ। অনেকে দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। ব্যবসার ধারণা বিনিময়ের সুযোগ তৈরি হওয়ায় দেশে থেকেও অনেকে নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে আসছেন। ফলে সিলেটে এখন উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে।’ 

ব্যবসায় সঠিক পরিকল্পনা রাখার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকেই নতুন ব্যবসা শুরু করেন। তবে সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় কিছুদিন পর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। গত কয়েক বছরে সিলেটে এরকম অনেক উদ্যোক্তা এসেছেন, কিন্ত সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় টিকে থাকতে পারেননি। ব্যবসা শুরুর পূর্বে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ। পরিকল্পনা অনুসরণ করলেই টিকে থাকা সম্ভব।’

এনপি-০৪