জামালগঞ্জে বাড়ছে বন্যার পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জুলাই ১২, ২০২০
১২:১৮ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১২, ২০২০
১২:১৯ পূর্বাহ্ন



জামালগঞ্জে বাড়ছে বন্যার পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ

আরেক দফা বন্যার কবলে পড়েছেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের মানুষ। আগের পানি শুকাতে না শুকাতেই ফের পানিতে ভাসছেন উপজেলাবাসী। রাস্তাঘাট তলিয়ে অধিকাংশ বাড়িঘর থইথই করছে পানিতে। এতে রাস্তাঘাটসহ বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গেল কয়েকদিন আগে বানে ভাসার দুর্ভোগ এখনও কেউ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার উপর আবার দেখা দিয়েছে বন্যা। 

এ অবস্থায় মারাত্মক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামের পর গ্রাম। খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম দুর্যোগকাল অতিক্রম করছেন। একদিকে নিজেদের ভোগান্তি, অন্যদিকে গরু-বাছুর, ভেড়া-ছাগল, হাঁস-মুরগী ও পুকুরের মাছসহ নানা সমস্যায় পতিত হয়েছেন উপজেলার অধিকাংশ লোকজন। দুর্যোগ কবলিত এসব মানুষ ত্রাণের আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। অপরিচিত কেউ খোঁজখবর নিতে গেলে একটু সাহায্যের আর্তি জানাতে এগিয়ে আসছেন বানভাসী মানুষ।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, আজ শনিবার (১১ জুলাই) দুপুর ১২টা পর্যন্ত সুরমা নদীর সুনামগঞ্জ সদর পয়েন্টে বন্যার পানি বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির স্বাভাবিক গতি ৭.৮০ মিটার পেরিয়ে সুরমার পানি প্রবাহ বর্তমানে ৮.৩১ মিটার পর্যন্ত উঠেছে। পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের বন্যাকবলিত চাঁনপুর ও সোনাপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রাম দু'টো পানিতে নিমজ্জিত। গ্রামের রাস্তাঘাটে ঢেউ খেলছে কোমর সমান পানি। অনেক বাড়ির বসতভিটেসহ প্রায় পুরোটাই তলিয়ে গেছে। কেউ জাল দিয়ে ভেসে যাওয়া পুকুর সামলানোর চেষ্টা করছেন। অনেকের গরু-বাছুর পানিতে তলানো খড়ের গাদার সামনে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে দেখা গেছে। পানিবন্দি অসহায় অনেকে কোনোরকমে জেগে থাকা গ্রাম্য দোকানে বসে অভিশপ্ত সময় পার করছে। পরিচয় জেনে তারা এই প্রতিবেদকের কাছে নিজেদের বন্যাক্রান্ত কষ্টের কথা তুলে ধরে সাহায্য-সহযোগিতার আবদার জানিয়েছেন।

পাগনা হাওর পারস্থ চাঁনপুর (আবুর হাঁটি) গ্রামের মো. বজলুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশ থেকে ঘিরে ধরা পানিতে ভাসছে তার বসতভিটে ও হাঁসের খামার। লোকালয় থেকে খানিক দূরে দ্বীপের মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। ঘর ও খামারে পানি ঢুকে মারাত্মক ক্ষতি ও ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে পুরো পরিবারটিকে। চলতি বন্যায় এ রকম ঝুঁকি ও ক্ষতির সম্মুখীন উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। দুর্যোগপূর্ণ এই পরিস্থিতিতে তারা এখন সরকার ও বিত্তবানদের দিকে তাকিয়ে আছেন। সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাকে এখন জরুরি ভিত্তিতে বানভাসী মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করছেন উপজেলার সচেতন মহল।

খামারি বজলুর রহমান বলেন, 'পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাও বাড়তে থাকে। বন্যায় একদিক থাইক্যা নিজে বাঁচন, অন্যদিকে খামার নিয়া টিক্যা থাকন- দুইটাই ঝুঁকিতে। এই দিনে ক্ষতির মুখে তো আছিই, আছি জীবন লইয়া টানাটানির মাঝেও। কেমনে বাঁচমু এইডাই অখন বড় কথা।'

বন্যায় বিপর্যস্ত সোনাপুর গ্রামের সত্যরঞ্জন দত্ত বলেন, ‘সব তলাইয়া গেছে। দাঁড়ানোর মতো জায়গা নাই। আমরা অখন স্কুল আর উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়া খাইয়া না খাইয়া কোনোরকমে দিন পার করতাছি। আমরা সাহায্য চাই। কেউ যদি সাহায্যের লাগি আগাইয়া না আয়, তা হইলে পানি আমরার না খাইয়াই মরণ লাগব।'

চাঁনপুর গ্রামের গন্ধরাজ কর বলেন, 'চারদিক দিয়া শুধু পানি আর পানি। কই গিয়া দাঁড়াইমু, কার কাছে যাইমু? হখলেই পানিতে খাড়াইয়া আছে। না খাইয়া মানুষ তো মরবই, তার সঙ্গে গরু-বাছুরডিও ভাইস্যা যাইব। আপনারা একটু সাহায্য করইন আমরারে।'

বেহেলী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের ঝুনু রায় বলেন, 'বাড়িত পানি উইঠ্যা গেছে। গরু-বাছুর খেরকুডা লইয়া এখন স্কুল বাড়িত উঠতে হইব। এছাড়া কোনো গতি নাই।'

আছানপুর গ্রামের মো. রাসেল মিয়া বলেন, 'কয়দিন আগে যে পানি হয়েছিল বর্তমানে তার চেয়েও বেশি পানি। ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবার বাড়িতে পানি। মানুষ খুব বিপদকাল অতিক্রম করছে।'

প্রাক্তন ইউপি সদস্য ও উপজেলা খেলাঘর আসরের সভাপতি আলী আক্কাছ মুরাদ বলেন, 'প্রথম বন্যার পানি দ্রুত চলে গেলেও এখনকার পানিটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। মানুষের ভোগান্তিও চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে। পানিবাহিত রোগশোকসহ খেয়ে না খেয়ে মারাত্মক দুর্দশায় পতিত হবে মানুষ। তাই সকল জনপ্রতিনিধি ও সরকারি সংস্থাকে দ্রুত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।'

বানভাসীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, 'বন্যাকবলিতদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে সকল স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছে। সকল চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের বলে দেওয়া হয়েছে তারা যেন বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। পাশাপাশি নৌকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বানভাসীদের মাঝে শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে আমি এখন নৌকায় আছি। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।'

 

বিআর/আরআর-০৫