দুই নদীর ভাঙনে বদলে যাচ্ছে গোলাপগঞ্জের মানচিত্র

ফারহান মাসউদ আফছর, গোলাপগঞ্জ


জুলাই ১৫, ২০২০
০৭:৫৩ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১৫, ২০২০
০৭:৫৩ অপরাহ্ন



দুই নদীর ভাঙনে বদলে যাচ্ছে গোলাপগঞ্জের মানচিত্র

নদীপাড়ের বাড়ি ছেড়ে আসবাবপত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে গোলাপগঞ্জের বাঘা ইউনিয়নের রুস্তমপুর গ্রামের একটি পরিবার।

সিলেটের গোলাপগঞ্জে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর অব্যাহত ভাঙনে নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ ফসলি জমি। বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। অব্যাহত ভাঙনে চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নদীপাড়ের মানুষ জানান, ভাঙন বন্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে তাদেরকে পথে বসতে হবে। ভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ নেই জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই।

জানা যায়, গোলাপগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে দেশের দুই প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারা। উত্তরদিকে গোলাপগঞ্জ পৌরসভা, গোলাপগঞ্জ সদর ইউনিয়ন, বাঘা ও ফুলবাড়ি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সুরমা নদী।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঘা ইউনিয়নের পূর্বগাঁও, লালনগর, জালালনগর, খালোপাড়, কান্দিগাঁও, রস্তমপুর, মজিদপুর, তুড়কভাগসহ বিভিন্ন স্থানে সুরমা নদীতে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বাঘা মাদরাসা, ঐতিহ্যবাহী রুস্তমপুর জামে মসজিদ ও হাতিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইতোমধ্যে মাদরাসার সীমানা প্রাচীরসহ সামনের অনেকাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ কান্দিগাঁও খেয়াঘাটটির একপাশের মাটি সম্প্রতি ধসে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

বাঘা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য স্যায়িদ আহমদ সুহেদ বলেন, 'গত কয়েকমাস আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।' তিনি বাঘা ইউনিয়নকে নদীভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে অতি দ্রুত প্রতিরোধমূলক কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবি জানান।

অপরদিকে সুরমার দক্ষিণপাড়ে ঐতিহ্যবাহী সরকারি এমসি একাডেমি স্কুল ও কলেজ, রানাপিং আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজ, চকরিয়া সুরমা ডাইক (গাঙপারি রোড) ভাঙনের মুখে রয়েছে। এমসি একাডেমি নদীভাঙন থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে। রানাপিং আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজে বালির বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাচীরের নিচের মাটি ধসে গেছে। যেকোনো সময় সীমানা প্রাচীর ধসে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে চকরিয়া বাজার সংলগ্ন সুরমা ডাইকের বিভিন্ন অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে বুধবারীবাজার, শরিফগঞ্জ, বাদেপাশা ও ভাদেশ্বর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বসতবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, খাদ্যগুদাম, মাদরাসা, ইউনিয়ন কমপ্লেক্স, পাকা সড়ক, হাটবাজার, দোকানপাট ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙনের মুখে রয়েছে। একের পর এক নদীপাড়ের ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেশ কয়েকটি হাট-বাজারসহ অনেক স্থাপনা ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বুধবারী বাজার ইউনিয়নের কালিজুরি চন্দরপুর বাজার থেকে লামাচন্দরপুর, বনগাঁও থেকে বুধবারিবাজার ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত চরম ভাঙনের মধ্যে রয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঘিরঘাট উচ্চবিদ্যালয় ও চন্দরপুর প্রাইমারি স্কুল। চন্দরপুর ও কালিজুড়ি এলাকার বিশাল অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বসতভিটা হারিয়ে মানুষ অন্যের বাড়িতে, হাওরে অথবা কোনোরকমে অস্থায়ীভাবে খুপড়ি ঘর তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছেন।

ভাঙনের শিকার বুধবারিবাজার ইউনিয়নের কালিজুড়ি গ্রামের পাখি বেগম বলেন, 'নদীর ভাঙনের কারণে গত কয়েকবছরে কৃষিজমি ও বসতভিটাসহ সব হারিয়েছি। এখন অন্য একজনের জায়গায় বসবাস করছি।'

চন্দরপুর গ্রামের মন্তু মিয়া বলেন, 'নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে আমার বসতভিটা। এখন অন্য একটি জায়গায় সবার সহযোগিতায় কোনোরকমে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস করছি।'

এ ব্যাপারে বাদেপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মস্তাব আহমদ কামাল বলেন, 'নদীর ভাঙন রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নদীর এ সর্বগ্রাসী ভাঙন থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনও একসময় নদীগর্ভে চলে যাবে।' তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের নদীভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

অপরদিকে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের খাটকাই কুশিয়ার বাজার ও মেহেরপুর বাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে নদীভাঙনের ঝুঁকিতে। পনাইরচক উচ্চবিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর ইতোমধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে। খাটকাই-মেহেরপুর, বসন্তপুর কটলিপারা ও ডাইক রাস্তার বেশ কয়েকটি স্থান নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে চলে গেছে। এতে করে এসব এলাকার লোকজনকে বিকল্প রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে।

নদীভাঙনের কারণে ভিটে হারিয়েছেন শরিফগঞ্জ ইউনিয়নের পনাইরচক গ্রামের রেকিব আলী। তিনি বলেন, 'নদীভাঙনের কারণে আমার বাড়িঘর সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি।'

গ্রামের সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ইয়াজুল ইসলাম বলেন, 'কুশিয়ারা নদীর ভাঙনে সড়ক ভেঙে বেহাল হয়ে যাচ্ছে। এখন সড়ক ভেঙে যাওয়ায় গাড়ি চালাতেও সমস্যা হচ্ছে। এতদিন ধরে নদীভাঙন চলতে থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা রোধে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।'

নদীভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়ে শরিফগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমান লুতি বলেন, 'নদীর ভাঙনে আমার বাড়িসহ এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি যেন অতি দ্রুত ভাঙন প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নইলে এই এলাকা কুশিয়ারার গ্রাসে বিলীন হয়ে যেতে পারে।'

এদিকে বাদেপাশা ইউনিয়নের হাজিরকোনা গ্রাম থেকে ডেপুটিবাজার-মফজ্জিল আলী দ্বিপাক্ষিক উচ্চবিদ্যালয়, বাগলাছয়ঘরি থেকে বাগলা বাজার এবং আছিরগঞ্জ খাল থেকে আমকোনা এলাকা এই ৩টি পয়েন্ট ভয়াবহ ভাঙনের মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে মফজ্জিল আলী দ্বিপাক্ষিক উচ্চবিদ্যালয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাগলা বাজার। ভাঙনে এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বসন্তপুর-কটলিপাড়া সড়কের বাগলা বাজার সংলগ্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় সড়কটির এই অংশ ধসে পড়ার আশঙ্কার কথা জানান এলাকাবাসী।

ভাঙনের শিকার বাদেপাশা ইউনিয়নের বাগলা গ্রামের শমছু বেগম বলেন, 'নদীভাঙনের কারণে আমার ঘরবাড়ি সব বিলীন হয়ে গেছে। এখন আমি অন্যের বাড়িতে বসবাস করছি।'

এ ব্যাপারে বাদেপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মস্তাক আহমদ বলেন, 'আমরা বরাবরের মতোই কর্তৃপক্ষের কাছে ভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়ে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি। নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে অচিরেই এই ইউনিয়নের কয়েকশ ঘরবাড়ি ও কৃষিজমিসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।' নদীভাঙন থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষায় তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

অন্যদিকে ভাদেশ্বর ইউনিয়নের শেখপুর জামে মসজিদ থেকে শাহ চম্পা (রহ.) এর মাজার পর্যন্ত এলাকা ভয়াবহ ভাঙনের মুখে রয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে ইউনিয়নের গোয়াসপুর এলাকা ও শীতেশ্বর এলাকা। এছাড়া কুশিয়ারার ভাঙনের শঙ্কায় রয়েছে ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের সুনামপুর ও ইসলামপুর এলাকা।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান বলেন, 'সুরমার ভাঙন হুমকিতে থাকা রানাপিং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় ও বাঘা মাদরাসার কাছ থেকে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন পাওয়ার পরিপেক্ষিতে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। আর উপজেলার অন্য কোনো জায়গায় ভাঙন প্রতিরোধের কোনো আবেদন পেলে আমরা বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাব। আর কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নদীভাঙনের সম্মুখীন হয় এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের না জানায়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।'

 

এফএম/আরআর-০২