জামালগঞ্জে নদীর পেটে ঘরবাড়ি, হুমকিতে মসজিদ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জুলাই ১৮, ২০২০
০৬:৫৮ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১৯, ২০২০
০৩:১৮ পূর্বাহ্ন



জামালগঞ্জে নদীর পেটে ঘরবাড়ি, হুমকিতে মসজিদ

নূরপুর জামে মসজিদ ভবনের বেশ কিছু অংশ নদীতে চলে যাওয়ায় সেটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।

স্রোতস্বিনী সুরমার আগ্রাসী খেলায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জের বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষের। নদীর প্রলয়ঙ্করী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছেন তারা। বাপ-দাদার পুরোনো ভিটে বেশ আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে তাদের। নদীর ভয়াল আগ্রাসনে ধসে পড়েছে অনেক সাজানো বাড়ি। কয়েক দফা বাড়ি বাঁধার পরও নদীভাঙনের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না তারা। নদীর করাল গ্রাসে ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসেছে অসংখ্য পরিবার। সর্বশেষ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাকালীন বর্তমান সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতিতে দেশ এগিয়ে গেলেও ভাঙন রোধ করার মতো কেউ এগিয়ে আসেননি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

জানা যায়, যুগ যুগ ধরে এই আগ্রাসী নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে সাচনা বাজার ইউনিয়নের নূরপুর ও সাচনা বাজার, জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের সোনাপুর, চাঁনপুর ও মমিনপুর, ফেনারবাঁক ইউনিয়নের গজারিয়া, রামপুর ও আমানীপুর (বর্মণ পাড়া) সহ উপজেলার ১০-১২টি গ্রামের মানুষ। দিন দিন সংশ্লিষ্টদের আশ্বাস-প্রশ্বাস শানিত হলেও ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি দূর করতে গ্রহণ করা হয়নি কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। এ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন ভাঙনের বলি কয়েক গ্রামের মানুষ।

ভাঙনের শিকার সাচনা বাজার ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। নদীর তীর ঘেঁষে দোদুল্যমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি বসতভিটা ও বাড়ি। নূরপুর জামে মসজিদ ভবনের অর্ধেক নদীতে চলে যাওয়ায় সেটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সর্বনাশা সুরমার পানি নামাজের পুরোনো এই স্থাপনাটির নিম্নাংশের মাটি খোদাই করে গ্রাস করে ফেলেছে। তার পাশে দাঁড়ালে ফুলে-ফেঁপে ওঠা পানির ধাক্কায় ওই ভবনের কাঁপুনি টের পাওয়া যায়। যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে মসজিদসহ ওই গ্রামের অনেকটি বাড়িঘর। গ্রাম ঘুরে নদীভাঙনের এমন দুর্বিষহ চিত্রই চোখে পড়েছে।

অপরদিকে নদীভাঙন সরেজমিনে দেখতে জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চাঁনপুর ও সোনাপুর গ্রামে গেলে ভুক্তভোগী মানুষেরা নিজেদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এই প্রতিবেদকের সামনে। বন্যায় নদী ও চারপাশ পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় ভাঙনের তীব্রতা দেখা না গেলেও ভুক্তভোগীদের কথায় ভাঙন কতটা ভয়ঙ্কর তা আঁচ করা গেছে। এমনকি নিজেদের বাপ-দাদার ভিটে হারিয়ে নদীত্রাসের শিকার মানুষেরা কোথায় কিভাবে কতটা কষ্টে আছেন সেই পীড়িত কথাই উঠে আসে তাদের জবানিতে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ফেনারবাঁক ইউনিয়নের আমানীপুর (বর্মণ পাড়া) গ্রামটি পুরোটাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্মণ সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই গ্রামটিতে অবশিষ্ট বলতে কিছু নেই। ভিটেমাটিহারা ওই পরিবারগুলো স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমানে পার্শ্ববর্তী নতুন একটি গ্রামে (করুণাপুর) মাথাগোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। বছর দুয়েক আগে তাদেরকে সরকারিভাবে কোনোরকম দাঁড়ানোর জায়গা করে দেওয়া হলেও দেওয়া হয়নি ঘর বাঁধাসহ আনুষঙ্গিক কোনো সুবিধা। নিজের খরচে সেখানে নামমাত্র ঘর তোলে জীবনধারণ করে আসছে মাছশিকারী ২৭টি পরিবার। এর মধ্যে ১০টি পরিবার আছে যারা কর্মসংস্থানের খোঁজে বাড়ি ফেলে শহরে চলে গেছে। আর বাকি পরিবারগুলো মাছ ধরে ও বিক্রি করে প্রচণ্ড কষ্টে জীবনধারণ করছে এখানে। তারা ভাঙনের তাড়া খেয়ে নতুন জায়গায় আবাস গড়লেও সেখানেও আছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করার চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছরই ডুবে যায় তাদের ভিটেমাটি। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে জানিয়েছেন এখানকার মানুষ।

করুণাপুর গ্রামের জয়মোহন বর্মণ বলেন, 'আমানীপুর সারা গ্রামডাই নদীতে ভাইঙা গেছে। একটা গাছই শুধু আছে। এছাড়া আর কিছু নাই। আমরা এখন করুণাপুর আছি। দুই বছর আগে সরকার থাইক্যা কিছু মাটি ফালাইয়া আমরারে খাড়াইবার জায়গাটা শুধু কইরা দেওয়া হইছে। নিজের টেয়ায় ঘর বাইন্দা এইখানে বাস করতাছি। একটু বেশি পানি হইলেই বাড়িত পানি উইঠ্যা যায়। বর্তমানে আমরা স্কুলবাড়িতে আছি। বাড়িঘর নীচু হওয়ায় পানি উইঠ্যা গেছে।'

নূরপুর গ্রামের মধ্যবয়সী রেজয়ান আহমদ আলম বলেন, 'নদীভাঙন দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। ছোটবেলায় একবার আব্বাকে দেখেছি বিলীন হওয়া বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে। বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি নিজেও ভাঙনের শিকার হয়ে দুইবার বাড়ি বানিয়েছি। ছোটকালে দেখা বাড়িঘর যেখানে ছিল, সেটা এখন পূর্ণাঙ্গ নদী। অন্তত ৩০০ হাত ভেঙে বর্তমানে এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।'

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'নদীর কবলে পড়ে বাড়ি তৈরি করতে করতেই আমাদের জীবন পানি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাড়ি যাচ্ছে নদীতে, অন্যদিকে আবাদী জমি হচ্ছে বাড়ি। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইলেও আমরা নদীগর্ভে বিলীন হতে হতেই শেষ। নজির হোসেন থেকে সোহেল সাব, বর্তমানে রতন এমপি, সবাই আশ্বাস-প্রশ্বাসই শুধু দিয়ে গেছেন। আর আমরা শুধু শুনেই যাচ্ছি। বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না।'

নূরপুর জামে মসজিদের মোতওয়াল্লি মো. রইছ মিয়া চৌধুরী ভাঙনের শিকার নামাজের স্থানটি দেখিয়ে বলেন, 'এই ভবনের প্রায় অর্ধেকটাই পানিতে। পাড় গর্ত হইয়া বিল্ডিংয়ের ভেতরে পানি খেলতাছে। যেকোনো সময় ভাইঙা পইড়া যাইব। নামাজের এই ঘরটা বানাবার সময় নদীর তীর থাইক্যা কমপক্ষে দুই আড়াইশ হাত জাগা রাইখ্যা তারপরে বান্ধা হইছিল। আর এখন নামাজের জায়গা নাই। মক্তবে নামাজ হয়। কয়দিন পরে মসজিদই থাকত না।'

অশীতিপর এই বৃদ্ধ আরও বলেন, 'এমন কইরা গ্রামের প্রতিটা বাড়ির মানুষই বিপদে আছে। নদী বাড়ি ভাইঙা নেয়, তারা আবার ঘর বান্ধে। এই বয়সে আমি বেশ কয়েকবারই বাড়ি বানছি। বানতে বানতে মনে হয় কয়েকশ হাত পিছাইছি। একসময় এই গ্রামই থাকত না। তারপরও সাহায্য করবার লাগি কেউ আগাইয়া আয় না, এইডাই দুঃখ।'

একই গ্রামের মো. আব্দুল মতিন বলেন, 'ভাঙনে কতখানি ক্ষতি হইছে এইডা আর কইয়া লাভ নাই। নদীর পাড় দিয়া সড়ক আছিল। এই সড়ক এখন মাঝ নদীতে। ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বুড়া হইছি। এখন আমরার পোলাপানে যুদ্ধ করব। কিন্তু কোনো সরকারই আমরার উপকার করল না।'

সোনাপুর গ্রামের ভিটেচ্যুত মনোরঞ্জন কর বলেন, 'এইডা একটা প্রাচীন গ্রাম। কিন্তু প্রাচীনতার সবকিছু নদীর পেটে চইলা গেছে। এখন পানিতে নদী ভরাট হওয়ায় কিচ্ছু দেখতে পাইতাছইন না। হুকনার দিন আইলে বুঝতাইন কিভাবে ধ্বংস হইতাছে গ্রাম। আমরা হক্কলের পুরান বাড়ি নদী খাইয়া ফেলাইছে। বর্তমানে যেখানে আছি সেটা সম্পূর্ণ নতুন। সর্বনাইশ্যা এই নদীর কড়াল গ্রাসে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই এখন নিঃস্ব।'

চাঁনপুর গ্রামের গোপেন্দ্র কর আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, 'নদীর ওইপারে চর জাগা যে জায়গাগুলো আছে, এগুলো কাগজে-পত্রে আমরার রেকর্ডের জায়গা। কিন্তু নদীতে বিলীন হওয়ায় এখন অন্য কেউ ভোগদখল কইরা আছে। আর আমরা এখন আছি পথের ধারে ঘর বাইন্ধা।'

একই গ্রামের মো. হারুন মিয়া বলেন, 'এখানে যে পরিবারগুলো আছে সবাই সর্বস্ব হারিয়ে এখন বিলীন হয়ে গেছে। তাদের বাড়ি বলতে কিছু নাই। অনেকেই ভিটেমাটি হারাইয়া রাস্তা কিংবা খাস জমিতে ঘর বাইন্ধা কোনোরকমে বাঁইচা আছেন।’

এ ব্যাপারে সংরক্ষিত আসনের (সিলেট-সুনামগঞ্জ) সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা আক্তার খানম বলেন, 'সম্প্রতি মাননীয় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এসে নদীভাঙন দেখে গেছেন। এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। আমি আশাবাদী, ভাঙন রোধকল্পে যথাসময়েই কাজ শুরু হবে এবং নদী তীরবর্তী মানুষের সমস্যাও সমাধান হবে।'

সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, 'এই প্রকল্পের জন্য কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। আশা করি অচিরেই কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।'

 

বিআর/আরআর-০৪