এমন প্রলয়ঙ্করি বন্যা আগে দেখেননি হাওরবাসী!

শামস শামীম, সুনামগঞ্জ


জুলাই ২৩, ২০২০
০৮:৫০ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৪, ২০২০
০৭:৩৮ অপরাহ্ন



এমন প্রলয়ঙ্করি বন্যা আগে দেখেননি হাওরবাসী!

হাওর-বাওরের দেশ সুনামগঞ্জ। ঝড়, বন্যাসহ ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখে অভ্যস্ত হাওরবাসী। সাময়িক দুর্যোগ মোকাবেলা করেই টিকে আছেন এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে ৩টি বন্যা দেখার কথা স্মরণ করতে পারছেন না হাওরাঞ্চলের প্রবীণরাও। কখনও এমন ধারাবাহিক ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হতে হয়নি তাদের। এবারের ৩টি বন্যায় বিপর্যস্ত হয়েছেন হাওরবাসী। এক বন্যার ক্ষত না শুকাতেই আরও দু'টি বন্যা দুর্ভোগের মুখে ফেলে দিয়েছে তাদের।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানীগাঁও গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব দিনমজুর আব্দুল কদ্দুছ, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সোনাপুর গ্রামের ৮২ বছরের ওয়াহিদ আলী, জগাইরগাঁও গ্রামের ৮০ বছর বয়সী তরজুদ আলী আর সুনামগঞ্জ শহরের ৯০ বছর বয়সী তেঘরিয়া এলাকার ব্যবসায়ী নূরুল হক জানান, তারা সবাই এই দীর্ঘ জীবনে অনেক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছেন। তবে ২০ দিনের ব্যবধানে পর পর ৩টি ভয়াবহ বন্যা দেখেননি তাদের একজনও।

এই বন্যায় তিন দফায় আব্দুল কদ্দুছের কাঁচা ঘরটি প্লাবিত হয়েছে। ছেলে বাউল লাল শাহ'র গানের ঘর ডুবে গানের যন্ত্রপাতি সব নষ্ট হয়ে গেছে। খুব কষ্টে আছেন তিনি। তার বাঁশের কাঁচা ঘরটি ধসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জগাইরগাঁও গ্রামের তরজুদ আলী বলেন, 'আমার বয়সে ইলাখান বইন্যা দেখছি না। ২০ দিনের ভিতরে ৩টা বইন্যায় মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত অইছে। ঘরবাড়ি আরাইছে। একজন আরেকজনের ঘরো যাইব হেই ব্যবস্থাও নাই।'

সোনাপুর গ্রামের ওয়াহিদ আলী বলেন, 'উটাউটি তিন বন্যা দেখছি না। আমরার ঘরবাড়ি, ক্ষেত নষ্ট করছে। রাস্তাঘাট ভাইঙ্গা নিছে। মাইনষেরে দাঁড়াইবার সুযোগ দিতেছে না বন্যা। মানুষ এখন অসহায়। ঘর-দুয়ার সব নষ্ট অইয়া গেছে।'

এভাবেই এবারের তিন আগ্রাসী বন্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে বলছিলেন প্রবীণরা। তারা স্মৃতি হাতড়ে স্মরণ করতে পারছেন না অল্পদিনের ব্যবধানে এমন ৩টি ভয়ঙ্কর বন্যার কথা। এই বন্যার জন্য নদী-হাওর ভরাট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এবং পরিকল্পনাবহির্ভুতভাবে সড়ক নির্মাণ দায়ী বলে মনে করছেন তারা।

সুনামগঞ্জে গত ২৬ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত প্রথম দফায় বন্যা হয়। এতে রাস্তাঘাট ও মৎস্যখামারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মানুষের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। ধসে পড়ে অনেক গরিব মানুষের কাঁচা ঘরবাড়ি। এই ক্ষত না শুকাতেই গত ৯ জুলাই দ্বিতীয় দফা বন্যা দেখা দেয়। বন্যা পুরো জেলায় বিস্তার লাভ করে। এতে লাখো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বন্যার ক্ষত না শুকাতেই আবারও গত ১৯ জুলাই ৩য় দফা বন্যা দেখা দেয়। আবারও ক্ষতির মুখে পড়েন জেলাবাসী। অসহায় মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার আগেই বন্যা এসে তাদেরকে দুর্ভোগে ফেলে দিয়েছে।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সুনামগঞ্জের মাথার উপরে চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া জেলায় বিপুল বৃষ্টিপাতও হয়েছে। এতে নদ-নদী উপচে পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। অনেক হাওরও ভরে গেছে নদীর জলে। পরে হাওরের গ্রামগুলোও নিমজ্জিত হয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন অসহায় মানুষজন।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, 'আমার এই জীবনে এমন টানা বন্যা দেখিনি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে আবহাওয়া আচরণ পাল্টেছে। এর সঙ্গে হাওরাঞ্চলের নদ-নদী ও হাওর ভরাট হয়ে যাওয়া এবং ভূপ্রকৃতি বিবেচনা না করে অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণেও বন্যার পানি দ্রুত সরছে না। জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।'

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, 'পাহাড়ি ঢলে আসা বালু-পলিতে ভরাট হচ্ছে হাওরের নদী-নালা, খাল-বিল এবং হাওর। ফলে বন্যার পানি ধারণ ক্ষমতা কমছে। প্রকৃতি বিবেচনায় অবকাঠামো নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করি।'

 

এসএস/আরআর-০৮