জামালগঞ্জে বাড়ি বাড়ি পানি, ঘরে ঘরে দুর্ভোগ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জুলাই ২৫, ২০২০
০৮:৫৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৫, ২০২০
০৮:৫৭ অপরাহ্ন



জামালগঞ্জে বাড়ি বাড়ি পানি, ঘরে ঘরে দুর্ভোগ

টানা তৃতীয় দফা বন্যায় চরম অস্বস্তিতে আছেন জামালগঞ্জের প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। পানির দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছে উপজেলার প্রতিটি লোকালয়। তেড়েফুড়ে আসা এই পানি হাট-বাজারসহ অধিকাংশ বাড়ি তলিয়ে হানা দিয়েছে বসতঘরে। পানিবন্দি ঘরে বসেই প্লাবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার পরিবার। উপর্যপুরি বন্যায় কাজকর্ম হারিয়ে বিপাকে পড়েছে এসব এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ। টানা বন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অবস্থা হয়েছে অধিকাংশ মানুষের। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এসব মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একদিকে পানিতে ধসে পড়ছে তাদের ঘরবাড়ি, অন্যদিকে গৃহপালিত পশু নিয়ে আছেন মহাবিপদে। এছাড়া মাছভর্তি পুকুর তলিয়ে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন মাছ চাষীরা। তিন দফা বন্যার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অচল হয়ে পড়েছে জনজীবন। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত সাহায্য-সহযোগিতা না পেলে বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়। যদিও পানি কিছুটা কমেছে, তারপরও বন্যাপরবর্তী দুর্ভোগ আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলা সদরের সন্নিকটে থাকা গ্রামগুলোর মানুষ যতটা না কষ্টে আছেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন হাওর তীরবর্তী প্রান্তিক মানুষেরা। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনে ঘোর বিপদ নেমে আসে। ঘরবাড়িতে বন্যার নেতিবাচক প্রভাব তো আছেই, এর মধ্যে প্রচণ্ড ঢেউ আর আফালে তছনছ হওয়া বাড়িঘর রক্ষায় তাদেরকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বসতভিটার উপর আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ভয়াবহতা ঠেকাতে জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নৌকা নিয়ে কচুরিপানা সংগ্রহে বের হচ্ছেন হাওর এলাকার বন্যাবিপন্ন অনেক মানুষ। হাওরের আফালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে খেয়ে না খেয়ে সর্বদা বানের পানিতে ডুবে মরছেন তারা। উপজেলা সদর থেকে তাদের অবস্থান দূরে হওয়ায় সাহায্য-সহযোগিতাও তেমন পৌঁছে না বানভাসী এসব মানুষের কাছে। যেটুকু পৌঁছে, তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

ফেনারবাঁক ইউনিয়নের বিনাজোড়া গ্রামের উৎপল পুরকায়স্থ বলেন, 'আমাদের প্রধান সমস্যা ঢেউ। পানি বাড়লেই ঢেউয়ের ধাক্কায় আমাদের বাড়ি-ঘরে ভাঙন সৃষ্টি হয়। তলিয়ে যায় ঘরবাড়ি। পুরো গ্রামই বন্যা ও ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। ঢেউ থেকে রক্ষা পেতে জারমুনি ও পাইন বনের খোঁজে বের হতে হয় আমাদেরকে। এর মাঝে তিন-তিনবার বন্যা প্রচণ্ড দুর্ভোগে ফেলে দিয়েছে হাওরাঞ্চলের মানুষকে। এভাবেই খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন চলছে আমাদের।'

জামালগঞ্জ নতুনপাড়াস্থ আব্দুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলটি সম্পূর্ণ পানিমগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া বিদ্যালয়ের নীচতলায় প্রায় কোমরসম পানি। স্কুলের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী বাড়ির কয়েকটি পরিবার। স্কুলে আশ্রিত ওই পরিবারগুলোর বাড়িঘর পানিতে ভেসে গেছে। প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়া বানভাসি মানুষগুলো সাহায্যের আর্তি জানিয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ছায়েদ আলী বলেন, 'বার বার পানি আসায় মাটি চইলা গিয়া ঘরটা ডাইবা গেছে। যার লাগি এই পানিতে ঘরে উড়াত পানি হইছে। দুইদিন আগে যখন স্কুলবাড়িতে উঠি, তখন রাইত প্রায় ২টা। পানি বাড়তে বাড়তে ঘরে উইঠ্যা গেলে তাড়াতাড়ি বৃষ্টি ও বাতাসের মাঝেই ছোট্ট এই নৌকায় কইরা বৌ-বাচ্চা নিয়া স্কুলে আশ্রয় নেই। এখন খুব কষ্টের মধ্যে আছি। চারপাশে পানি। সাহায্য ছাড়া আমরার কোনো গতি নাই।'

সাচনা বাজারে সদাই করতে আসা বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের রাজিনপুর গ্রামের মো. মাসুক মিয়া বলেন, 'গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পানি। আমাদের গ্রামের (রক্তি নদীর তীরবর্তী) বেলডুপ হাঁটির ৪০টি বাড়ির মধ্যে ৩৫টি ঘরেই পানি ঢুইক্যা গেছে। এর মধ্যে কয়েকটা পরিবার স্কুলবাড়িতে গিয়া উঠছে। বাকিরা গরু-বাছুর নিয়া পানির মধ্যেই কষ্ট কইরা বসবাস করতাছে। এই রকম পরিস্থিতিতে সবারই সরকারি সাহায্য দরকার।'

বেহেলী ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের মো. হিরন মিয়া বলেন, 'বাড়ি বাড়ি পানি, ঘরে ঘরে দুর্ভোগ। বদরপুর গ্রামের নদীর উত্তরপাড়ের হাঁটির অনেক পরিবারই বাড়িঘর ছাড়া। প্রায় সব বাড়িঘরেই পানি। তারা কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে কেউ বা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অপরদিকে গ্রামের দক্ষিণের হাঁটিও প্রায় পানিমগ্ন। তবে হালি হাওরের প্রচণ্ড ঢেউ আমাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জারমুনি দিয়ে কোনোরকমে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। বড় কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে আমাদের।'

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের নয়াহালট গ্রামের মো. সুন্দর আলী বলেন, 'আমার ঘরের বারান্দায় পানি উইঠ্যা গেছে। আরেকটু বাড়লে ঘরটাই ডুইব্যা যাইব। আমার পাশের ঘরে প্রায় হাঁটু পানি। হেরা অন্য বাড়িতে গিয়া আশ্রয় নিছে। এই রকম অবস্থা প্রায় সব বাড়িতেই। বার বার পানি আইতাছে। খুব কষ্টের মধ্য দিয়া সময় যাইতাছে আমরার। কোনো কাম-কাজ নাই। কি কইরা বাঁচমু? আফনেরা একটু সাহায্য করেন।'

সাচনা বাজার ইউনিয়নের মফিজনগর গ্রামের মনফর আলী বলেন, 'এইবার লইয়া তিন তিনবার পানি উঠছে ঘরে। একটা গরু আছিল। এই গরুটা কুকড়াপশীতে মেয়ের বাড়িতে রাইখ্যা আসছি। ঘরে অনেক পানি ছিল। বালু দিয়া কোনোরকমে রান্নার জায়গাটা করছি। মাটির চৌকায় রাইন্দা-খাইয়া বাইচ্যা আছি। গত বন্যায় ১ কেজি চিড়া পাইছিলাম। এইডা দিয়া কি জীবন চলে?'

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, 'এখন পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তারপরও আমরা তৎপর আছি। বন্যার্তদের ভিজিএফ দেওয়া হচ্ছে। দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে।'

 

বিআর/আরআর-০৮