তিন দফা বন্যায় সর্বস্বান্ত সুনামগঞ্জের মৎস্য খামারিরা

বিশেষ প্রতিনিধি


জুলাই ২৭, ২০২০
০৮:০১ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৭, ২০২০
০৮:০১ অপরাহ্ন



তিন দফা বন্যায় সর্বস্বান্ত সুনামগঞ্জের মৎস্য খামারিরা
সড়কে ক্ষতি ৪৩০ কোটি টাকা

মাত্র একমাসের ব্যবধানে হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে ৩টি ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যা পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে সুনামগঞ্জের মৎস্য খামারিদের। জেলার ৩ হাজার ৩শ ৪৯ জন খামারির ৪ হাজার ৫২টি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মৎস্য খামার করা এসব ব্যবসায়ীরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন।

একফসলি বোরো এলাকা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জে অন্যান্য ফসল না থাকায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে চলতি রোপা আমনের জন্য বীজতলা তৈরি করায় ৫৯ হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে ২২০ হেক্টর জমির আউশ ধান। এতে প্রায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। টানা বন্যার কারণে এবার রোপা আমন ফলনে বিলম্ব হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তাছাড়া বন্যায় সড়ক ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়েছে। চারটি উপজেলার সঙ্গে এখনও সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্যায় রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ায় দুর্ভোগে আছেন মানুষ। তিন দফা বন্যায় সুনামগঞ্জে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ৩০ কোটি টাকা এবং সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুনামগঞ্জ মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকবছর ধরে সুনামগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের আগ্রহ বেড়েছে। নতুন নতুন খামারিরা বড় বিনিয়োগ করছেন এই খাতে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও মাছ চাষে ঝুঁকেছেন। জেলায় পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে গত ২৬ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত প্রথম দফায় বন্যা হয়। ওই বন্যায় ২৭ জুন সবচেয়ে বেশি পানি বৃদ্ধি পায়। ওইদিন হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার বেশিরভাগ পুকুরই ডুবে যায়। এতে পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে যায়। অবকাঠামোরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই বন্যার ক্ষত না শুকাতেই আবারও ৯ জুলাই থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত আরেক দফা বন্যা হয়। এতে যা অবশিষ্ট ছিল, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে আবারও বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে আবারও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় মানুষ।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মৎস্য খামারি ইসলাম উদ্দিন ব্যাংক থেকে ১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ৯টি পুকুর করে নানা প্রজাতির মাছ চাষ করেছিলেন। গত বৈশাখে তার কাজ শেষ হলে মাছ চাষ শুরু করেন। এবারের বন্যায় তার ৯টি পুকুর থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।

ইসলাম উদ্দিন বলেন, 'আমি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প তৈরি করে খামার করেছিলাম। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। পাহাড়ি ঢলে পুকুরের তীরও ভেঙ্গে দিয়ে গেছে। এখন কিভাবে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করব আর কিভাবে আবার উৎপাদনে যাব সেই চিন্তায় অস্থির আছি।'

একই উপজেলার মোল্লাপাড়া এলাকার ক্ষুদ্র খামারি জুনেদ আহমদ ও আমিনুল ইসলাম। তারা ৩টি পুকুরে প্রায় ৫ লাখ টাকার মাছ চাষ করেছিলেন। বন্যায় দু'টি পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে। তাদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা। আমিনুল ইসলাম বলেন, 'ধার-দেনা করে ৩টি পুকুরে মাছ চাষ করেছিলাম। বন্যায় শুধু সব মাছই ভেসে যায়নি, পুকুরেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারি প্রণোদনা না পেলে আর খামার করতে পারব না।'

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'বন্যায় এবার সুনামগঞ্জের খামারিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা দেখা দিয়েছে অনেকেরেই। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করেছি।'

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সফর উদ্দিন বলেন, 'বর্ষা মৌসুমে সুনামগঞ্জে তেমন ফসল থাকে না। তাই ক্ষয়ক্ষতিও তেমন নেই। তবে বন্যায় রোপা আমনের কিছু বীজতলা ও অল্প যে আউশ ধান ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার কারণে রোপা আমনের বীজতলা ডুবে থাকায় বীজ ফেলতে বিলম্ব হচ্ছে। এতে রোপা আমন চাষ কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে।'

সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'বন্যায় আমাদের প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৪০টি সেতু-কালভার্ট এপ্রোচসহ নষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে আমাদের।'

সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, 'বন্যায় আমাদের ২৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পেভমেন্ট, শোল্ডার, বিটুমিন ও সার্ফেসিং এর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে আমাদের।'

 

এসএস/আরআর-০৫