বন্যায় সর্বস্বান্ত তাহিরপুরে নেই ঈদের আমেজ

আবির হাসান-মানিক, তাহিরপুর


জুলাই ৩০, ২০২০
০৯:২৩ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ৩০, ২০২০
০৯:২৩ অপরাহ্ন



বন্যায় সর্বস্বান্ত তাহিরপুরে নেই ঈদের আমেজ

কয়েকদিন আগের ছবি

সাম্প্রতিক সময়ে মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে বেকার ও কর্মহীন হয়ে বিপাকে পড়েছেন হাওরাঞ্চলের লোকজন। চলমান এ অবস্থার আর্থিক মন্দাভাবের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দফায় দফায় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ভিটেমাটি হারিয়ে এখন অসহায়ত্বের স্পষ্ট ছাপ হাওর পরিবেষ্টিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লোকজনের চোখেমুখে। লকডাউনের ফাঁদে পড়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাহিরপুরের নানা পেশার ব্যবসায়ীসহ সকল শ্রেণির মানুষ। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে পথে বসে যেতে হয়েছে অনেককেই। আর এখন সাম্প্রতিক বন্যায় বিপর্যস্ত হাওরবাসী এ বহুমাত্রিক সংকট কিভাবে সামলাবেন তা ভেবেই যেন ক্লান্ত আর দিশেহারা।

হাওরাঞ্চলে নানামুখী সংকটের মধ্যে দরজায় কড়া নাড়ছে মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদের বাকি আর মাত্র দুইদিন কিন্তু ঈদ উৎসব উদযাপনের বদলে হাওরপাড় আর যাদুকাটা নদী তীরবর্তী পরিবারগুলোতে এবং সীমান্তে শুল্ক স্টেশনের হাজারও শ্রমিকসহ উপজেলার সর্বত্র বিরাজ করছে আর্থিকভাবে বহুমাত্রিক সংকট আর বিপর্যয়ের শঙ্কা। পরিবার-পরিজন নিয়ে পশু কোরবানি আর ঈদের কেনাকাটার বদলে পরিবারগুলোতে চলছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ঈদ আনন্দের পরিবর্তে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের নিজেদের হারানো বসতভিটায় পুনর্বাসনের মাধ্যমে কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে- এটাই যেন এখন হাওরবাসীর একমাত্র চাওয়া-পাওয়া।

সরেজমিনে ভাটির জনপদ তাহিরপুরের রাজধানী খ্যাত বাদাঘাট বাজার ঘুরে বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়ায় অসহায়ত্বের সুর। আর এখন কয়েক দফায় বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া এ অঞ্চলের লোকজন নিজেদের বসতভিটা, গবাদি পশু আর গোলার ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পড়েছেন আরও নানামুখী আর্থিক ক্ষতিতে।

বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাদাঘাট বাজারের ব্যবসায়ী আকবর কসমেটিকসের কর্ণধার আকবর হোসেন বলেন, 'ঈদের কেনাকাটা বলতে যা বোঝায় তা এখনও খুব একটা জমে ওঠেনি। ক্রেতার উপস্থিতিও কম। করোনা আর তারপর বন্যা দুই সংকটে পড়ে লোকজন আর্থিকভাবে বহুমুখী বিপাকে পড়েছে। যে কারণে মার্কেটগুলোতে এখনও আগেকার মতো জমে ওঠেনি ঈদের বেচাকেনা।'

নিউ রয়েল ফ্যাশন এন্ড শাড়িঘরের মালিক রয়েল আহমেদ বলেন, 'করোনা ও বন্যায় এ অঞ্চলের লোকজন বর্তমানে বিপাকে আছেন। সব মিলিয়ে এবারকার ঈদের বেচাকেনা মন্দের ভালো বলা যায়।'

বড়ছড়া বাজারের ব্যবসায়ী আমিরুজ্জামান বলেন, 'এবার এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে মন সায় দিচ্ছে না। কারণ বন্যায় হাওরপাড়ের অনেকেরই ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় এসব পরিবার নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ আর অসহায়ত্ব দেখে কি ঈদের আনন্দ করা যায়? তাছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। সব মিলিয়ে হাওরবাসীর কাছে এবার ঈদের আনন্দের চেয়ে দুর্ভোগ আর সংকট উৎরানোর প্রচেষ্টাই যেন মুখ্য হয়ে দাড়িয়েছে।'

এদিকে উপজেলার অন্যতম বৃহৎ কোরবানির পশুর হাট বাদাঘাট বাজারের পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, কোরবানির পশু পর্যাপ্ত আমদানি হলেও ক্রেতার সংখ্যা কম। একাধিক খামারি ও বেপারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাটে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত কোরবানির পশু থাকলেও ক্রেতারা দামের দিক থেকে আশানুরূপ আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। দাম কমবে না কি বাড়বে- এ নিয়েও ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই রয়েছেন দ্বিধায়। গত দুইদিন প্রত্যাশানুযায়ী দামে গরু বিক্রি করা যায়নি। প্রত্যাশার চেয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বিক্রেতাদের। তাছাড়া করোনা ও বন্যা পরিস্থিতিতে এবার কোরবানির সংখ্যাও অনেকাংশে কম হবে- এমনটিই আভাস দিচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি।

উপজেলার বড়দল (উত্তর) ইউনিয়নের বারহাল গ্রামের বাসিন্দা মো. তারা মিয়া নামের এক খামারি বলেন, 'গত ২-৩ বছর যাবৎ এই গরু লালন করতে গিয়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ করেছি। সব মিলিয়ে গরুর মূল্য দাঁড়িয়েছে লাখ টাকার উপরে। কিন্তু ৮৫-৯০ হাজার টাকার বেশি কেউ দাম দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।'

হাটে কোরবানির পশু কিনতে আসা শ্রীপুর (উত্তর) ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের সবুজ মিয়া বলেন, 'গত কয়েকমাস ধরে করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এখন আবার বন্যায় নতুন করে সংকটে পড়েছি। হাতে টাকা-পয়সা যা জমানো ছিল তা দিয়েই কোরবানির পশু কিনব ভেবেছি। গরুর দাম আগের বছরের তুলনায় কম হলেও আর্থিক সংকটের কারণে এ টাকাই অনেক বেশি মনে হচ্ছে।' 

বাদাঘাট বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ইজারাদার মো. মাসুক মিয়া বলেন, 'প্রথমদিকে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন অবস্থায় গরুর হাট বসাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এখন লকডাউন উঠে যাওয়ায় কোরবানির হাটে গরু-ছাগল মিললেও ক্রেতা তেমন নেই। শুরুতে করোনা পরিস্থিতি আর সাম্প্রতিক বন্যা, সব মিলিয়ে এবার ইজারায় লোকসান গুনতে হবে।'

 

এএইচ/আরআর-০৯