জামালগঞ্জে এক পরিবারের ৭ জনই বাক প্রতিবন্ধী

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


আগস্ট ০৭, ২০২০
০৪:৩৭ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ০৭, ২০২০
০৪:৩৭ অপরাহ্ন



জামালগঞ্জে এক পরিবারের ৭ জনই বাক প্রতিবন্ধী
অভাব অনটনে অনিশ্চিত জীবন

এক পরিবারের ৭ জনই বাক প্রতিবন্ধী। এমন খবর সংগ্রহে গেলে তাদের বাড়ির বিপরীত দিকে খেয়াঘাট সংলগ্ন লালপুর বাজারে দেখা হয় তাদেরই একজনের সঙ্গে। তেরো-চৌদ্দ বছরের ওই কিশোর খেয়া ঘাটের নৌকার মাছি। বাবার অনুপস্থিতিতে সে এই নৌকার হাল ধরেছে। 

তাকে বাজারে পেয়ে তোমাদের বাড়িতে যাব বললে নিরুত্তর হাঁটতে থাকে বাক প্রতিবন্ধী কিশোর। তার পিছু হেঁটে নৌকায় উঠি। কোনো কথা না বলে নৌকার ইঞ্জিন চালিয়ে বিপরীত পারে ছুটতে লাগল। গন্তব্যে গিয়ে দেখা গেল সেখানে প্রতিবন্ধী আরেক ভাই দাঁড়িয়ে। দুই ভাইকে নিয়েই তাদের বাড়িতে ওঠা।

সেখানে যেতেই চোখ চলে যায় অগোছালো চুল আর ছিন্ন বসনধারী মেয়েটির দিকে। কথা না বলতে পারলেও নিজের ভাষায় আমাদেরকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে সে। তার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল সেও ওই ৭ প্রতিবন্ধীর একজন। বাড়িতে থাকা অন্য ভাইবোনদের অপ্রকৃতিস্থ বোবা চেহারায় স্পষ্টতই ভেসে উঠছিল প্রতিবন্ধীত্বের চাপ। মুখে কথা নেই, হাসি নেই। নিষ্প্রাণ মুখচ্ছবি দেখলে বোঝা যায়, কষ্টের তাড়নায় কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না তারা। এক অভিশপ্ত জীবন নিয়েই তাদের বেঁচে থাকা।

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ওই প্রতিবন্ধী পরিবারের বসবাস। আলী উস্তার ও মিনারা বেগম দম্পতির ৯ সন্তানের ৭ জনই বাক প্রতিবন্ধী। তাদের ৬ পুত্র ও ৩ কন্যা সন্তানের মধ্যে ৫ ছেলে, ২ মেয়েই বোবা। কথা বলতে পারে না। তাদের এই প্রতিবন্ধীত্ব জীবন জন্মগতই বলে জানিয়েছেন মা মিনারা বেগম।

প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জীবন নিয়ে চিন্তিত মা মিনারা বেগম বলেন, ‘এখন হয়তো তাদেরকে নিয়ে কোনো রকম চইল্যা যাইতাছি। তারার বাপ এমনিতেই অসুখে ভোগতাছে। কোমর ধরা লইয়াই ফেরি নৌকাডা চালায়। যদি বাপ বিছনাত পড়ে তাহলে কি হইব। কেমনে চলব সংসার। তখন তো না খাইয়া উপাসে মইরা যাইব আমার পুলাফান। সরকার থাইক্যা আমার বোবা ছেলেমেয়ের নামে স্থায়ী একটা কিচ্ছু কইরা দিলে একটু চিন্তামুক্ত হইতাম।’

ভাতাদি কিছু পান কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুইটার নামে ভাতা পাই। দুই-তিন বছর আগে খবর পাইয়া ডিসি সাব আমরার বাড়িতে আইছিল। তখন তাইন অফিস থাইক্যা মানুষ পাঠাইয়া দুইডা ভাতা কইরা দিছইন। কিন্তু মেম্বার চেয়ারম্যানরা কেউ কোনোদিন আমরার খবরই লইছে না। এখনও লয় না। বোবা পোলাপানরে নিয়ে কীভাবে আছি সেটা কেউ দেখে না।’

মিনারা বেগমের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, তার একটা মেয়ে ও একটা ছেলে শুধু কথা বলতে পারে। কথা বলা মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন। সে এখানেই থাকে। বারো-তেরো জনের পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা। স্বামী আলী উস্তার হোসেনপুর ও লালপুরের মধ্যকার ফেরি চালিয়ে যে আয় করেন সেটা দিয়েই কোনোরকম সংসারের খরচ চলে। কোমরে ব্যথা বাড়লে স্বামী আর ফেরি চালাতে পারেন না। তখন বোবা ছেলেদের যেকোনো একজনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরি চালাতে পাঠানো হয়। নইলে উনুনে হাড়ি বসে না তাদের।

প্রতিবেশি সামছু উদ্দিন বলেন, ‘তারা জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। একটা পরিবারের ৯ জন ছেলেমেয়ের মধ্যে ৭ জনই প্রতিবন্ধী হলে কতটা কষ্ট তা শুধু ওই জন্মদাতা মা-বাবাই বুঝতে পারেন। ওই পরিবারটি সত্যিকার অর্থেই কষ্টের মধ্যে আছে। অভাব-অনটন তো আছেই। গ্রামের মানুষ যদিও তাদের কিছুটা সাহায্য-সহযোগিতা করে, তবে তা দিয়ে কি পরিবার চলে? এদের প্রতি একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন।’

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মুজাফফর হোসেন বলেন, ‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে বললে আমি চেষ্টা করব। আমাকে না বললে তো আমি কিছু করতে পারি না।’

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. রজব আলী বলেন, ‘এদের দুইজন প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। আরেকজনের নাম দেওয়া হয়েছে। আর যেকোনো ত্রাণসামগ্রী এলে তাদেরকে দেওয়া হয়। আমি ওই পরিবারটির প্রতি সর্বদাই নজর রাখি।’ পিতা আলী উস্তার বাড়িতে না থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এনপি-০৫