জামালগঞ্জে বন্যা : ক্ষয়ক্ষতি ৩০ কোটি টাকার অধিক

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


আগস্ট ১১, ২০২০
০৯:১৮ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ১১, ২০২০
০৯:১৮ অপরাহ্ন



জামালগঞ্জে বন্যা : ক্ষয়ক্ষতি ৩০ কোটি টাকার অধিক

সাম্প্রতিক তিন দফা বন্যায় নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলা। এখনও বন্যার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে পুরো উপজেলা। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পুকুর, হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশুর খামার তলিয়ে সর্বাগ্রে ক্ষতি হয়েছে ৩০ কোটি টাকারও বেশি। এবারের টানা তিন বন্যা মৎস্য চাষি ও খামারিদের একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে। বাড়িঘর ভেঙ্গে হাজার হাজার অস্বচ্ছল পরিবারকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। জেলা শহরের সঙ্গে সংযোজিত জনগুরুত্বপূর্ণ সড়ক ছাড়াও অধিকাংশ গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রায় ধস নামিয়ে দিয়েছে বন্যা। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্যায় বিপর্যস্ত বাড়িঘর ঠিক করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কাজকর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়া বানভাসি অসংখ্য পরিবার। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন পোল্ট্রি খামারি ও পুকুরে মাছ চাষ করা মানুষজন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সামর্থ নেই। তারা সরকারি ঋণ সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সুদমুক্ত ঋণ পেলে হয়তো অনেকে আবার খামার ও মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। বন্যা পরবর্তী দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন হাওরপাড়ের মানুষ।

উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, বন্যায় উপজেলার প্রায় সকল মৎস্য চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। উপজেলার ২৭৯ জন মৎস্য চাষি ৩১৫টি পুকুরে মাছ চাষ করেছেন। ১০৫.৭৬ হেক্টর আয়তনের পুকুরে চাষকৃত মাছের পরিমাণ ৯০.৪৬ ও পোনা ১০.৩২ মেট্রিক টন। বন্যায় পুকুর ডুবে গেলে প্রায় সব পুকুরের মাছই বের হয়ে যায়। জাল কিনে বেড় দিয়ে আরেক দফা ব্যয় করেও চাষিরা আটকাতে পারেননি পুকুরের মাছ। এতে করে প্রায় সর্বস্বান্ত অধিকাংশ মাছ চাষি। এ অবস্থায় তারা সুদমুক্ত ঋণের প্রত্যাশা করছেন।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ কামলাবাজ গ্রামের কলেজপড়ুয়া ছাত্র তোফাজ্জল হোসেন রতন জানিয়েছেন, করোনার অবসরকে কাজে লাগাতে তারা ৭ জন পুকুর ও হাওরে মাছ চাষে আগ্রহী হন। পুকুরসহ হাওরে পানি থাকাকালীন সময়ে নেট ও বাঁশ চাটাইয়ের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা ব্যয় করে তারা মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু উপর্যুপরি বন্যায় তাদের সব স্বপ্ন তলিয়ে গেছে পানিতে। বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনন্দা রানী মোদক বলেন, 'জেলা মৎস্য কার্যালয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষিদের তালিকা চেয়েছে। আমরা প্রতিদিনই হালনাগাদ তালিকা জেলা কার্যালয়ে পাঠাচ্ছি। তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে সেগুলো পাঠাবেন। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারব।'

উপজেলা প্রাণীসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বন্যায় হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশুর খামারও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলায় গবাদি পশুর খামার আছে ১৯২টি। তাতে আংশিক হিসাব অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া আংশিক হিসাব মতে, হাঁস-মুরগীর ২২০টি খামারে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেশি হবে। কারণ উপজেলার আনাচে-কানাচে অনেক খামার আছে যেগুলো সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে বাঁধা হয়েছে বিধায় ক্ষতির সঠিক হিসাব জানে না বলে জানিয়েছে প্রাণীসম্পদ কার্যালয়।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের নয়াহালট (পূর্বহাঁটি) গ্রামের বাসিন্দা হাঁসের খামারি মো. দিলসাদ মিয়া বলেন, 'আমার খামারে ৬০০ হাঁস আছিল। বন্যার সময় খামারে কোমর পর্যন্ত পানি হইছে। পরে বাধ্য হইয়া দেড়শ'র মতো হাঁস বাজারে হাঁইট্যা বিক্রি করছি আর বাকিডি মইরা গেছে। বন্যায় প্রায় দেড় লাখ টাকার ক্ষতি হইছে আমার। এখন যদি সরকারি কোনো ঋণ না পাই তা হইলে পরিবার চালাইতে মারাত্মক সমস্যা হইব।'

উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবুল কাসেম বলেন, 'ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই ঋণের জন্য আসে আমাদের কাছে। কিন্তু তাদের ক্ষতিগ্রস্ত খামার পরিদর্শনের জন্য বললে তারা রাজি হয় না। কারণ তারা নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে যত্রতত্র খামার স্থাপন করেছে। এ ধরণের নানা বাধ্য-বাধকতা থাকায় আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে সঠিক রিপোর্ট পাঠাতে পারি না। যাদের রেজিস্ট্রেশন আছে তারা এলে আমরা অবশ্যই সহযেগিতা করার চেষ্টা করব।'

উপজেলা এলজিআরডি অফিস সূত্রে জানা গেছে, তিন দফা বন্যায় রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার ছোট-বড় সড়ক মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ হবে আনুমানিক ২৫ কোটি টাকা। জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়কের উজ্জ্বলপুর অংশে প্রায় ৫ কিলোমিটার, জামালগঞ্জ-সেলিমগঞ্জ অংশে প্রায় ১৩ কিলোমিটার ও সেলিমগঞ্জ-গজারিয়া অংশের প্রায় ৮ কিলোমিটার রাস্তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার তোড়ে এই তিন অংশ ভেঙে হাওরের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া সাচনা-মমিনপুর ও সাচনা-রামনগর রাস্তাসহ গ্রামীণ সড়কের অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সড়কগুলোর অনেক জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। অনেক অংশে রাস্তার ধারের মাটি সরে গিয়ে সড়কে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।

অন্যদিকে বন্যার পানিতে সাচনা-সুনামগঞ্জ সড়কের অধিকাংশ জায়গায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। পিচঢালা সড়কের উপরাংশের আবরণ সরে পাথর ও ইট বেরিয়ে এসেছে। এতে সাধারণ মানুষ যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব রাস্তা বন্যাসহনীয় টেকসই করে নির্মাণের দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা বিষয়ে উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. আব্দুস সাত্তার বলেন, 'বন্যায় রাস্তার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে এবং আগামীতে আরও হবে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় অবশ্যই বন্যাসহনশীল পরিকল্পিত টেকসই রাস্তা নির্মাণ করা প্রয়োজন। এজন্য প্রথমে সয়েল টেস্ট করতে হবে। যেসব স্থানে বন্যার ঝুঁকি আছে সেসব জায়গায় প্রতিরক্ষা দেওয়াল দিয়ে তারপর রাস্তা নির্মাণ করা জরুরি। হাওরাঞ্চলের রাস্তাগুলো মাটির তলে ৩ ইঞ্চি ঢুকিয়ে অন্তত ৬ ইঞ্চি পুরুত্ব করে সাব মার্জিবল অর্থাৎ ডুবন্ত রাস্তা করলে মানুষ হয়তো কিছুটা উপকৃত হবে।'

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, 'আমি প্রতিটি দপ্তরকে বলে দিয়েছি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্য। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি বিবেচনা করে যদি স্ব স্ব দপ্তর আমাদেরকে ঋণ ছাড়ের ব্যাপারে কিছু জানায়, তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।'

 

বিআর/আরআর-০৭