মৃৎশিল্পে করোনার ধাক্কা : পেশা ছাড়ছেন কারিগররা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


আগস্ট ১৪, ২০২০
০৫:৫৫ অপরাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ১৪, ২০২০
০৫:৫৫ অপরাহ্ন



মৃৎশিল্পে করোনার ধাক্কা : পেশা ছাড়ছেন কারিগররা

আর মাত্র কিছুদিন পরেই মনসা পূজা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উল্লেখযোগ্য পূজা উৎসবের মধ্যে মনসা পূজা অন্যতম। এ পূজা এলেই মৃৎশিল্পীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কিন্তু এবারকার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ প্রতিমা তৈরির কারিগরদের উপরে লেগেছে করোনার ধাক্কা। গোটা মৃৎশিল্পী সম্প্রদায়ের অল্পসংখ্যক মানুষ যখন নিজেদের আদি পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন, তখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নতুন করে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে তাদের। তাই এবারকার মনসা পূজায় অনেকটা কমে গেছে মৃৎশিল্পীদের প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততা। বছরের কয়েকটা পূজার মৌসুম কোনোরকমে তাদের রুটি-রুজির পথ করে দিলেও এবার বৈশ্বিক সমস্যা করোনা প্রতিমা কারিগরদের উভয় সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।

এমনিতেই আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের অংশ গ্রামীণ মেলা গ্রামগঞ্জ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ায় মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র ও খেলনা বিক্রির পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। তাই আদি পেশা পরিবর্তন করে অন্যভাবে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করছেন পাল সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ। যে দুয়েকজন এ পেশায় টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তারাও করোনার প্রভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। পেশা বিপন্ন হওয়ার পরিস্থিতিতে একে সরকারি প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসার জোর দাবি জানিয়েছেন তারা।

জামালগঞ্জের মৃৎশিল্পীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এটি তাদের আদি পেশা। বংশ পরম্পরায় অল্পসংখ্যক মানুষ এখনও কর্দমাক্ত মাটিকে নান্দনিক রূপদান করে যাচ্ছেন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলা সংকুচিত হওয়াসহ বাজারে প্লাস্টিক বস্তুর কদর বেড়ে যাওয়ায় কমে গেছে তাদের তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা। মাত্র দুই দশক আগেও বাংলার ঘরে ঘরে মাটির কারুকাজ সম্বলিত তৈজসপত্র বহুল ব্যবহৃত হলেও এখনকার চিত্র পুরোটাই উল্টো। তাই পাল সম্প্রদায়ভুক্ত অধিকাংশ মানুষ পেশা পরিবর্তন করেতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুই-চারজন যারা টিকে আছেন, তারাও নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ অবস্থায় বাঙালির ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অংশ পাল পেশাটি টিকে থাকার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে। ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এ পেশাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা অপরিহার্য বলে জানিয়েছেন তারা।

প্রতিমায় রঙ-তুলিতে ব্যস্ত জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের সাচনা (পাল হাঁটি) গ্রামের ধনঞ্জয় পালের ছেলে তরুণ মৃৎশিল্পী দীপংকর পাল বলেন, 'গতবার আমরা দুই জায়গা মিলিয়ে ২৫০টির বেশি মূর্তি বানিয়েছি। এবার মাত্র ১০০টি মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। করোনার জন্য তাও বিক্রি করতে পারব কি না সন্দেহ আছে। আগে এই হাঁটির অন্তত ২০ জন মূর্তি তৈরি করতেন। এখন একমাত্র আমরাই আছি। অন্যরা এই পুরোনো পেশা ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছেন। কারণ এ পেশায় এখন টিকে থাকার মতো পরিবেশ নেই।'

ধনঞ্জয় পাল বলেন, 'এই কাজ বাপ-দাদায় কইরা আইছে বিধায় এখনও লাইগা আছি এ কাজে। আমাদের পূর্বপুরুষরা মাটির মূর্তি, হাড়ি-পাতিল, খেলনা বানাইয়া জীবন চালাইয়া গেলেও আমরা আর পারতাছি না। অনেকেই অপারগ হইয়া এই পেশাডাই ছাইড়া দিছে। এর মাঝে এইবার করোনা দিছে আরও চিন্তার মধ্যে ফালাইয়া। করোনাভাইরাসের লাগি কম কইরা মনসা মূর্তি বানাইছি। মনে হয় সবগুলো বেচন যাইত না। এরপরে আইতাছে দুর্গা পূজা। এই পূজাতেও কতডা লাভ হইব তারও অনিশ্চিত। মোটকথা এই পেশাডাই এখন অনিশ্চিতের মধ্য দিয়া চলতাছে। আমরার টিইক্কা থাকতে সরকারি সহযোগিতা খবুই দরকার।'

একই গ্রামের ভিন্ন পেশায় চলে যাওয়া গিরীন্দ্র পালের ছেলে লোকেশ পাল বলেন, 'এ পেশায় এখন টিকে থাকা দায়। নরম মাটিতে হাত লাগিয়ে প্রতিমা বানানো সম্ভব, কিন্তু এতে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়ে বাজারে ছোটখাটো একটা দোকান দিয়ে ব্যবসার মধ্যে ঢুকে পড়েছি।'

 

বিআর/আরআর-০২