মরমীবাদের উৎস হচ্ছে সিলেট

সিলেট মিরর ডেস্ক


আগস্ট ২৩, ২০২০
০২:৫১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : আগস্ট ২৪, ২০২০
০৩:১৪ পূর্বাহ্ন



মরমীবাদের উৎস হচ্ছে সিলেট

সরকার আমিন। তিনি কবি। কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন প্রবন্ধ। অনুবাদও করেছেন বিদেশি ভাষার বই। যে দেশে দোয়েল-কুকিল-ময়নার বাস। সে দেশে থেকে সরকার আমিন গান করবেন না, তা কী হয়? গাইলেন গানও। তারঁ প্রথম কবিতার বই ‘রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর’ (যৌথভাবে) প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। তারপর থেকে একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’, ‘ইহকাব্য’, ‘চার পাঁচ হাজার পিঁপড়ার দুঃখ’, ‘ব্লেড দিয়ে কেটেছিলে জল’, ‘যাকে খুন করার কথা তাকে দেখে হেসে ফেলি’, ‘আড়াই হাজার বছরেরও পুরোনো চীনা দর্শন-কাব্য লাওৎস-এর তাও তে চিং সহজিয়া পথ’, ‘আমার স্নেহের কবিতা’, ‘আগুনের কাছে অনুরোধ’, ‘এ জার্নি বাই লাইফ’, ‘কিছু পাপ করার চেষ্টা করি’সহ মোট ২৪টি কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ ও সম্পাদনা গ্রন্থ। সরকার আমিন ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবিতার চিত্রকল্প বিষয়ে অর্জন করেছেন পিএইচডি ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমির উপপরিচালক পদে কাজ করছেন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সরকার আমিন এসেছিলেন সিলেট মিরর কার্যালয়ে। সেখানে দীর্ঘ আড্ডায় কথা হয় কবিতার নির্মাণ, গান ও সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে। সেই আড্ডার সংক্ষেপিত অংশ সিলেট মিরর পাঠকদের জন্য তুলে ধরছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক বেলাল আহমেদ।

 

সিলেট মিরর : সরকার আমিন ভাই আপনার কবিতা চর্চা দিয়েই শুরু করি। ১৯৯০ সালে আপনার প্রথম কবিতার বই ‘রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর’ প্রকাশিত হয়। এরপর আপনার বহু বই প্রকাশিত হয়েছে। আপনার লেখা প্রথম কবিতার গল্প শুনতে চাই। কখন মনে হলো আপনি একটি কবিতা লিখতে পেরেছেন? 

সরকার আমিন : আমার যখন বয়স ৬ বা সাত বছর তখন আমি আমাদের ঘরে একটা বিড়াল ছিল। বিড়ালটাকে খুব ভালোবাসতাম এবং সেই বিড়ালটাকে নিয়ে আমি একটা ছড়া লিখেছিলাম, ‘মিনি আমার পোষা বিড়াল, ডাকি আমি সকাল বিকাল।’ কোনো ছন্দ মিল ছিল না, কিন্তু ছড়ার মতো একটা কিছু হয়েছিল। পরে আমার মা-বাবা ওই ছড়া শুনে বলে আমার ছেলেতো কবি হয়ে গেছে। সারা গ্রামবাসীকে বলা শুরু করেছে ওতো বিড়ালকে নিয়ে কবিতা লিখে ফেলেছে। ওইটাই ছিল আমার প্রথম কবিতা এবং পারিবারিকভাবেও আমি স্বীকৃতি পেয়ে গেছি, আমি বিরাট কবি। সেটা অনেক বছর আগে, প্রায় ৪৫ বছর আগে।

 

সিলেট মিরর : একজন তরুণ লেখকে বই প্রকাশ করতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। আপনার প্রথম কবিতার বই প্রকাশকালীন সময়ের পরিস্থিতি কেমন ছিল?  

সরকার আমিন : ওই সময়ে আসলে একটা ভালো বিষয় হচ্ছে যে ফরহাদ মজহার আমাকে সাহায্য করেছিলেন। ফরহাদ মজহার আজকে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। কিন্তু তখন তিনি কবি, গান করতেন এবং প্রতিপক্ষ বলে একটা পত্রিকা বের করতেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। ওই প্রতিপক্ষ পত্রিকাতে উনি আমার ২০টা কবিতা আমার ছবিসহ ছেপে দিলেন। আমার কবিতা যে কত ভালো এইসব নিয়ে একটা ভূমিকা দিয়ে ছেপে দিলেন। সেই ৯০-এর দিকে। ওই সংখ্যাটা ঢাকাতে খুব আলোড়ন তৈরি করেছিল। আমরা রাতারাতি পরিচিত হয়ে গেলাম। আমি এবং শাহনাজ মুন্নী। দুজনকেই উনি ‘প্রেজন্ট’ করেছিলেন। মুন্নির একটা ছবি ও ২০টি কবিতাও ছিল তাতে। এই খ্যাতিটা আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। পরে `রুদ্ধশ্বাস বৈঠকের পর' এটা আমরাই বের করেছিলাম। তবে বইয়ের সকল কাজ করেছিলেন ফরহাদ মজহার। এ জন্যে আমি ফরহাদ ভাইয়ের ঋণ স্বীকার করি। কিন্তু একই সঙ্গে আমি এই কথাটি বলতে চাই, পরবর্তী সময়ে ফরহাদ ভাইয়ের যে ভূমিকা যেমন হেফাজতের সঙ্গে যুক্ততা, বিএনপি-জামাতের ঘরানার সঙ্গে যুক্ততা এটা আমি পছন্দ করি না। যে কারণে গত ১৪-১৫ বছরে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ফরহাদকে আমি ‘ওউন করি না’ তবে অনেক কৃতজ্ঞ তার কাছে। 

 

সিলেট মিরর : ব্যবহার্য, প্রতিদিনের জীবন যাপনের উপাদানগুলোই আপনার কবিতায় ব্যবহার করেন আপনি। কবিতা লিখা নিয়ে আপনার প্রস্তুতিটা নিয়ে জানতে চাই।

সরকার আমিন : এসব কিছুই না। বলতে পারেন আমার কবিতা হচ্ছে অচেষ্টার ফল। আমার ভেতরে যা জেগে ওঠে সেটা আমি প্রকাশ করি। কোনো ধরণের জবরদস্তি আমার কবিতায় নাই। যেমন ধরেন আমরা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি। আমরা চেষ্টা করে কি স্বপ্ন দেখি। চেষ্টা করে কি কেউ স্বপ্ন দেখতে পারে? তেমনি আমার কবিতা হচ্ছে স্বপ্ন দৃশ্য।

 

সিলেট মিরর : বাংলা সাহিত্যের পরাবাস্তববাদ নিয়ে কিছু বলুন। 

সরকার আমিন : এই পরাবাস্তববাদ, আপনি জানেনতো আমি পি.এইচ.ডি করেছি কবিতার চিত্রকল্প নিয়ে। এই চিত্রকল্প হচ্ছে সাহিত্যের ফর্মগুলো। আসলে বাস্তববাদ, পরাবাস্তববাদ, ভাববাদ, বস্তুবাদ এভাবে সত্যকে আলাদা করা যায় না। এগুলো হচ্ছে একধরনের ‘নেইমিং’, একধরণের নামকরণ করা। যেমন ধরুণ, আপনার সিলেটে যে নদীটা তার নাম আপনি রেখেছেন সুরমা। নদীটাতো তার নাম রাখেনি, না কি? নদীতো নদী, জল। আচ্ছা জল যে বলি। জল কি সে তার নাম রেখেছে? না সেও আমরাই তার নাম দিয়েছি জল। এধরণের কতগুলো নামকরণ আমরা করে যাই। এই নামকরণ একধরণের সুবিধা তৈরি করে। কিন্তু আসলে নামকরণের কোনো মানে নেই। ধরুন, আজকে যদি আমরা বলি সুরমা নদীটা সুরমা না। পদ্মাবতী। তাহলে কিছুদিন মানুষ রাগ করবে, ‘রিয়েক্ট’ করবে। কিছু মানুষ বলবে দেখ, আমাদের নদীর নামটা বদলে দিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখবেন মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নদী-নদীই। বা নদী নদীও না এটাকে নদী না বলে আমরা অন্য নামেও আখ্যায়িত করতে পারতাম। পরাবাস্তববাদ এরকমই একটি ‘নেইমিং’। এ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই আসলে। আমি এ ধরণের বিভক্তিকরণ বা শনাক্তকরণের যে রীতি এটা আমার কাছে কবি হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।  শিশুও চিৎকার করে কাঁদছে। এখন আপনি এ কান্নাকে গান বলবেন কি না। যদি সুন্দর করে সে কাঁদে, কান্নার মধ্যে একটা সুর থাকে, সেখানে একটা মিউজিক বসিয়ে দেওয়া যায়? তাহলে সেটাও সঙ্গীত। 

সিলেট মিরর : গানের প্রসঙ্গ যখন আসল আপনার গানলামি নিয়ে কথা বলতে চাই। নিজের কথা, সুর ও কন্ঠে আপনি শুরু করলেন ‘গানলামি’। নামটা বোধ হয় মুন্নী (শাহনাজ মুন্নী) আপার দেওয়া। তো সেই গানলামির গান নিয়ে আপনি একটি অ্যালবামও করলেন। গানলামি এখন কেমন চলছে? গানের জন্য যে প্রস্তুতি বা চর্চা দরকার সেটি আপনার ছিল কি?

সরকার আমিন : হ্যা একটা অ্যালবাম করলাম। এখন অনেকগুলো গান নিয়ে ইউটিউবে এবং ফেসবুকে আপলোড করি গানলামির গান। আর আমার মনের ভেতর আমি অনেক সুর খোঁজে পাই, ভেতরে আমার সুরের গুঞ্জন আছে। আমার নিজের ভেতরে সুর খেলা করে, এটা হচ্ছে প্রথম। দ্বিতীয়ত, ৩০ বছর ধরে আমি উচ্ছাঙ্গ সঙ্গীত শুনি। ব্যাপক মাত্রায় শুনি। কখনও কখনও চার-ছয় ঘন্টাও আমি গান শুনি। ফলে আমার কানটা তৈরি হয়েছে বলে আমার নিজের ধারণা। যেমন আমি যখন নিজে গান গাইতে শুরু করলাম তখন আমি কিছুই জানতাম না। কিন্তু যিনি আমার গানে মিউজিক যুক্ত করেছেন, অত্যান্ত প্রতিভাবান একজন তরুণ এসআর সজীব। সজীব আমাকে বললÑআমিন ভাই আপনি গানের কিছুই জানে না। কিন্তু আপনার গানের স্কেল ঠিক আছেÑকিভাবে সম্ভব। স্কেলতো কোথাও পড়ছে না। কারণ কি? কারণ ওই যে আমি ক্লাসিক্যাল মিউজিক ৩০ বছর ধরে শুনছি। শোনার একটা প্রভাব কিন্তু পড়ে। গানলামির সংকটটা কোন জায়গায়। সংকটটা হচ্ছে গলাটা তৈরি হয়নি আমার। কারণ গলা তৈরি করতে হলে যে চাষবাস করতে হয় গলার সারগাম করতে হয়, সেটা নাই। ফলে গলাটা হেমন্ত মূখোপাধ্যায়ের গলা নয়, সরকার আমিনের গলা। এখন কেউ যদি হেমন্তের গলার সঙ্গে আমর গলার তুলনা করে গান শুনে সে আসলে গান শুনতে চায়। গানলামি নয়। গানলামি কেন বললাম? গানলামি হচ্ছে অবিকল, অবিকৃত একেবারেই অকৃত্রিম একটা কন্ঠ গাওয়ার চেষ্টা করছে। এটা যারা পছন্দ করে তারা শুনছে। আর যারা এর সঙ্গে মেলাতে পারে না তারা নিতে পারছে না গানলামি। 

 

সিলেট মিরর : এবার কথা বলি সিলেট প্রসঙ্গে। সিলেটে আপনার প্রথম আসা। স্মৃতি থেকে সেই সিলেট নিয়ে যদি কিছু বলেন। 

সরকার আমিন : সিলেটে আমি প্রথম আসি বিয়ে করে। মুন্নীকে নিয়ে। একটা লাক্সারি হোটেলে উঠি। আমি বিয়ে করেছি হাতে টাকা নাই। তবু বউ নিয়ে ভালো হোটেলে থাকতে হবে। পরে টাকাটুকা কিভাবে জোগাড় করে সিলেটের একনম্বর হোটেলে আমি উঠব। পরে ওইটাতে উঠেছিলাম মুন্নীকে নিয়ে এসে। তারপর আমার বন্ধু কবি মোস্তাক আহমাদ দীন, ফজলুর রহমান বাবুল ওদেরকে নিয়ে অদ্ভূত সময় কেটেছিল আমাদের। এই প্রথম সিলেটে এসেছিলাম। পরে দীনদের বাড়ি গেলাম, ঘুরলাম। সিলেট খুব ভালোলাগে। সিলেট আমার কাছে একটা স্বপ্নের জায়গা।

 

সিলেট মিরর : সিলেটর কোন বিষয়গুলো আপনাকে টানে? 

সরকার আমিন : আমাকে টানে সিলেটের ভাষা। সিলেটের মানুষ যে সুন্দর করে কথা বলে। আঞ্চলিক উচ্চারণ ভীষণ সুন্দর। সিলেটের ভাষা আমার এতই ভালো লাগে যে শাহনাজ মুনীœকে বিয়ে না করলে আমি সিলেটেই বিয়ে করতাম। শুধু নারীদের কন্ঠে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা শোনার জন্য। এতো মিউজিক্যাল ভাষা আর হয় না। বিশেষ করে নারীদের কন্ঠে যখন শুনি মনে হয় কবিতা আবৃত্তি শুনছি। 

 

সিলেট মিরর : সিলেটের সাহিত্যচর্চা প্রসঙ্গে আপনার অভিমত। 

সরকার আমিন : সিলেটে অসাধারণ কিছু তরুণ কবির জন্ম হয়েছে। মুজিব ইরম, মোস্তাক আহমাদ দীন, শোয়াইব জিবরান, জফির সেতু এরা তো অসাধারণ লিখছেন। এরা তো জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কবি। আর কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কবিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার ধারণা কবি দিলওয়ারের কবিতার চেয়ে কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কবিতা অনেক ভালো। একদিন কিশওয়ার আমার অফিসে গিয়ে হাজির হলেন। উনি কবিতাসমগ্রটা আমাকে লিখে দিলেন। বললেন, ‘সরকার আমিন আপনাকে আমি ভালোবাসি।’ পরের সপ্তাহে সিলেটে এসেই মারা গেলেন। এটা আমার কাছে একটা ভয়ঙ্কর স্মৃতি। কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তিনি আধুনিক কবি। কবি দিলওয়ার আধুনিক কবি নন। একথায় অনেকেই হয়ত দুঃখ পাবে। দিলওয়ার একজন রোমান্টিক কবি কিন্তু জীবন বাস্তবতার যে জটিলতা কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের কবিতায় আমি পাই দিলওয়ারের কবিতায় আমি সেভাবে পাই না। আর সিলেটের মরমীবাদ। এ বিষয়ে বলার আর অবকাশ রাখে না। আমি মনে করিÑযে দার্শনিকতা পৃথিবীকে আগামী একশ বছর চালিত করবে সেটা হচ্ছে মরমীবাদ। ‘ওয়েস্টার্ন পাবলিকরা’ ক্লান্ত হয়ে গেছে। তারা দলবেঁধে এখন ভারতে আসে শান্তি খোঁজার জন্য। এই শান্তিটা তারা ইসলামি মৌলবাদের কাছে পাবে না, কারণ ইসলামি মৌলবাদ ভয় দেখায়। কিন্তু মরমীবাদ তাকে শান্তি দেয়। প্রেমের কথা বলে। আমরা কিন্তু ‘ওয়েস্টার্ন’ লোকদের টানতে পারছি না প্রাতিষ্ঠানিক মৌলবাদের কারণে। যদি আমরা এই সুফিইজমকে ধারণ করি তাহলে মানুষ সুফিইজমের কাছে ফিরে আসবে। আমি বিশ্বাস করি ‘ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড’ এখানে আসবে আত্মার শান্তি পাওয়ার জন্য। এবং তারা যাবে ওই হাওরের জলের মধ্যে, একটু বাতাস লাগাবে। কারণ ওরাতো প্রযুক্তির চূড়ান্ত স্থানে গেছে, ভোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর কি কোনো ভোগের বিষয় আছে? তখন কি থাকে। তখন ক্লান্তি আসে। এভাবেই সভ্যতা ক্লান্ত হয়ে গেছে। সভ্যতার জীবনীশক্তি মরমীবাদ। আর সে মরমীবাদের উৎস হচ্ছে সিলেট।