শামস শামীম, সুনামগঞ্জ
আগস্ট ২৪, ২০২০
১১:৫৫ অপরাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ২৪, ২০২০
১১:৫৫ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে পাহাড়ি ঢলের আগ্রাসন বেড়েই চলেছে। ঢলের তোড়ে বিলীন হয়ে গেছে সড়ক। বালু-পাথরে চাপা পড়েছে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, হাওর, খাল-বিল। এবারের তিন দফা বন্যায় পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। মেঘালয়ের ঢলে নেমে আসা বালু-পাথরে বসতঘর চাপা পড়ে কয়েকটি আদিবাসী পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে মেঘালয় পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
তাহিরপুর সীমান্তে বসবাসকারী লোকজন জানান, মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানের ফলে বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের আগ্রাসনের শিকার হন তারা। তারা জানান, মেঘালয়ে ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে কয়লা খনি খননের পর থেকেই মূলত পাহাড় ধসের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। প্রতিবছরই বর্ষায় এমন বালু-পাথর নেমে আসে।
সরেজমিনে সীমান্ত এলাকায় গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮ সালের ১৩ থেকে ২১ আগস্ট টানা বর্ষণে ভারতের ওয়েস্টহিল খাসিয়া পাহাড় (কালা পাহাড়) ভেঙ্গে তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী চানপুর-রজনীলাইন-পাহাড়তলী, কড়ইগড়া, লালঘাট ও ভুরুঙ্গাছড়ায় প্রায় ৪০০ একর কৃষিজমি ভরাট হয়। প্রায় ২০০ পরিবার কৃষিজমি ও ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়। এলাকায় ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, পুকুর আর হাওর বালু ও পাথরে চাপা পড়ে। ভরাট হয়ে যায় পাহাড়ি ছড়াগুলো ও একাধিক পুকুর। এ সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালু-পাথরে চাপা পড়ে কয়েকজন আহতও হন। চানপুর গ্রামের মেজর মৃ, সফলা সাংমা, উদাস সাংমা ও তার দুই মেয়েসহ আরও কয়েকজন আদিবাসী বাস্তুভিটা হারিয়ে তখন চানপুর পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
২০০৮ সালে পাহাড় ধসের ঘটনায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি উপদেষ্টা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন সুনামগঞ্জের বিডি হলে নাগরিক সমাবেশ করলে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে খাসিয়া রাজার ছেলে আদিবাসী নেতা এন্ড্রু সলোমারের নেতৃত্বে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
এদিকে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে আবারও পাহাড়ি ঢলে ওই এলাকায় প্রায় ২শ একর ফসলি জমি বালুতে ভরাট হয়ে যায়। ওইসময় কড়ইগড়া ছড়ায় স্লুইসগেটের তীরের বাঁধ ভেঙ্গে ১০টি আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজাই গ্রামের এন্ড্র সলোমার, সম্রাট মিয়া, ইউসুফ মল্লিক, আব্দুল আলী, জুয়েল মিয়া, আকবর আলী, মেজর উদাস সাংমা ও সফলা মারাকের প্রায় ২০০ একর আমন জমি বালুতে ভরাট হয়ে যায়। কড়ইগড়া স্লুইসগেটের বাঁধ ভেঙ্গে রমেশ মারাক, রোটালি দিও, লুসেন রাকসাম, রোটন ম্রং, মাইকেল ডিও ও সঞ্চিতা রাকসামের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে চলতি বছরের জুন ও জুলাই মাসের তিন দফা বন্যায় আবারও ওই এলাকায় বালু-পাথর নেমে এসে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, পুকুর ও ঘরবাড়ি চাপা পড়ে। পচাশোল হাওরের বেশ কিছু জমি নতুন করে বালুতে ভরাট হয়ে যায়। বড়গুপ-টেকেরঘাট সড়কের তিনটি সেতুর নিচে বালু-পাথরের স্তুপ তৈরি হয়েছে। চানপুর সড়কের প্রায় ২০০ কিলোমিটার এলাকা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে বিলীন হয়ে গেছে। বড়গুপটিলার নিচে অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিক ও ফসলি জমি বালুতে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এবারের ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালু-পাথরে রাজাই গ্রামের খাসিয়া রাজা উইক্লিব সিমের ছেলে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কোষাধ্যক্ষ এন্ড্রু সলোমারের প্রায় ২০ একর জমি বালু ও পাথরে চাপা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। বড়গুপটিলার নিচে তাহিরপুর ট্রাইবাল ফোরামের সাবেক সভাপতি পরিতোষ চাম্বুগং এর ১ একর ফসলি জমি বালুতে ভরাট হয়ে গেছে।
উত্তর বড়দল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আদিবাসী নেতা শঙ্কর মারাক বলেন, 'প্রতিবছরই মেঘালয় পাহাড় থেকে ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালু-পাথরে আমাদের এরাকার প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। এবার কড়ইগড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও ক্লিনিকের পাশের ফসলি জমি বালুতে ভরাট হয়ে গেছে। সীমান্তে বসবাসকারী কয়েকটি আদিবাসী পরিবার এ কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র চলে গেছে।'
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কোষাধ্যক্ষ ও আদিবাসী নেতা এন্ড্রু সলোমার বলেন, 'ভারতের মেঘালয়ে অপরিকল্পিত কয়লা ও ইউরেনিয়াম খনি খননের পর থেকেই মূলত পাহাড় ভেঙ্গে আমাদের ভাটির জনপদ তাহিরপুর সীমান্তে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আমার প্রায় ২০ একর জমি নষ্ট হয়ে গেছে বালুতে। এভাবে প্রতিবছরই ক্ষতি হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এ বিষয়ে সংলাপ করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।'
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সফর উদ্দিন বলেন, 'তাহিরপুর সীমান্তে সম্প্রতি হাওর ও আমন ধানের জমি বালু ও পাথরে চাপা পড়ার খবর আমরা পাচ্ছি। এতে আমাদের প্রচুর কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। কী পরিমাণ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমরা সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি।'
এসএস/আরআর-০৫