কাজী গোলাম কিবরিয়া, শ্রীমঙ্গল
সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০
০৪:৪২ পূর্বাহ্ন
আপডেট : সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০
০৪:৪২ পূর্বাহ্ন
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় যন্ত্রদানব ‘বোমা মেশিন’ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে অভিনব ‘রাতচোরা’ কৌশলে ক্ষেতের জমি ও পুকুর খননের নামে মূল্যবান সিলিকা বালু উত্তোলন করছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র। তারা দিনের পর দিন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করার ফলে ওই এলাকার ফসলি জমির আকৃতির শ্রেণি পরিবর্তন ঘটে ভূমিধসের আশঙ্কাসহ ভূমিকম্পের হুমকিতে রয়েছে তিন ইউনিয়নের ১৪/১৫টি গ্রামের কয়েকশ পরিবার। প্রতিদিন হাজার হাজার টন বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ ওই এলাকার কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ভূমিধস ও তীব্র পানি সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, মোটা অংকের অর্থের অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় একযুগ ধরে ওই চক্রটি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন মহলকে 'ম্যানেজ করে' অনেকটা নির্বিঘ্নে বোমা মেশিন দিয়ে ফসলি ক্ষেত ও মজা পুকুর শুকিয়ে কোটি কোটি টাকা দামের সিলিকা বালু বিক্রি করে সরকারের মোটা অংকের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াসহ গ্রামীন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ও এলাকার ফসলি জমির ভূপ্রকৃতির অবস্থান বিনষ্ট করছে। এর ফলে উপজেলার ভূনবীর, মির্জাপুর ও সিন্দুরখান এই তিনটি ইউনিয়নের ১৪/১৫টি গ্রামের ভূস্তরে পানির তীব্র সংকটসহ ব্যাপক ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে তোলা হাজার হাজার ঘনফুট এসব সিলিকা বালু প্রতি ঘনফুট ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। এই বালু ট্রাকযোগে চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দিন-রাত শত শত ট্রাকে পাচার করে একেকজন বালু ব্যবসায়ী অল্প দিনে গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে কোটিপতি সেজে 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' বনে গেছেন।
ওই সংঘবদ্ধ চক্র আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর ধরে উপজেলার ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের সাতগাঁও লছনা নামক স্থান থেকে সাতগাঁও স্টেশন চৌমোহনা, ভুনবীর চৌমোহনা থেকে মির্জাপুর ইউনিয়নের বৌলাশীর ও সিন্দুরখান এবং আশিদ্রোন ইউনিয়নের উদনাছড়া ও বিলাসছড়ার মতিগঞ্জ এলাকায় আঞ্চলিক সড়কের দুইপাশে অসংখ্য বালুর স্তুপ করে কোটি কোটি ঘনফুট বালু বিক্রি করছে। অথচ এদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান ছাড়া স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া শহরের সিন্দুরখান, কালীঘাট সড়ক ও রেলস্টেশন এলাকার সড়ক, ভানুগাছ সড়ক ও ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে কালাপুর ও শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশে অবৈধ বালুর ডিপো করে বালু বিক্রি করা হচ্ছে। এসব সড়কে বালুর রাখার কারণে ধুলোবালিতে সাধারণ মানুষজন চলাফেরায় চরম ভোগান্তিতে পড়লেও হয়রানির ভয়ে কেউ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছেন না। মাঝে-মধ্যে ফেসবুকে বা এলাকাবাসীর পক্ষে কেউ এসবের প্রতিবাদ জানালে প্রশাসন কিছুটা নড়েচড়ে বসে।
জানা যায়, এ অবৈধ ব্যবসা বেশি লাভজনক হওয়ায় গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ছড়া ও গ্রামের পুকুর থেকে বোমা মেশিন বসিয়ে বালু তোলার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের দুই-একটি অভিযানের ফলে ওই চক্রটি গত সপ্তাহ থেকে শুধু রাতের আঁধারে বোমা মেশিন বসিয়ে এসব মূল্যবান সিলিকা বালু উত্তোলন করে রাতেই ট্রাকে করে তা পাচার করছে। আর অব্যাহতভাবে বোমা মেশিনে বালু তোলার কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভূস্তরের পানির তীব্র সংকটসহ ১৪ থেকে ১৫টি গ্রামে ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় একটি সাধারণ বালু ও ২৮টি সিলিকা বালুসহ মোট ২৯টি বালুমহাল রয়েছে। এর মধ্যে বিলাসছড়া ও শাওনছড়া নামের দু'টি বালুমহাল সরকারিভাবে নিলাম ডাক দেওয়া হয়েছে। অথচ উপজেলাজুড়ে পাহাড়ি ছোট-বড় ছড়া ও ফসলি জমি থেকে বোমা মেশিন দিয়ে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলনের তীব্র প্রতিযোগিতা। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত বোমা মেশিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২৫/৩০ কিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাইপ বসিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার পাম্প ব্যবহার করে মাটির ১০০ থেকে ২০০ ফুট তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন করছে ওই প্রভাবশালী চক্রটি।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের অভিযানের ফলে গত ৮/১০ দিন ধরে দিনের বেলা ‘বোমা মেশিন’ দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এখন কৌশল পাল্টেছে বোমা মেশিন ব্যবহারকারী প্রভাবশালী চক্র। তারা এখন ‘রাতচোরা’ কৌশল নিয়েছে। রাতের আঁধারে সিন্দুরখান, ভূনবীর ও মির্জাপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ফসলি জমি ও পুকুর খননের নামে মেশিন দিয়ে লাখ লাখ টাকার বালু তুলছে তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভূনবীর ইউনিয়নের পূর্ব আলীশারকূল গ্রামের আছকর হাজীর বাড়ির উঠানে বিশাল আকারের বালির স্তুপ রাখা। আশপাশের লোকজন অভিযোগ করেন, বাড়ির পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে প্রতিদিন রাতে মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে সেখান থেকে রাতের বেলা বড় বড় ট্রাকযোগে ঢাকায় বালু পাচার করা হচ্ছে। একই ইউনিয়নের ভুনবীর, ভিমসী ও জীবনগঞ্জ এলাকার ফসলি জমি থেকে বালু উত্তোলন করছেন সিধাম, উজ্জ্বল, আসলম ও মুছাব্বির নামের বালু ব্যবসায়ীরা। জৈতাছড়া এলাকার পূর্বে হাওরের কৃষিজমিতে বোমা মেশিন লাগিয়ে বালু তুলেছেন ওই এলাকার বর্তমান ইউপি সদস্য আব্দুল ওয়াহিদ (হাওর মেম্বার) ও হান্নান মিয়া।
ইসলামপাড়া ইছামতি কাজী ফার্মের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করেছেন সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে কাওছার ও মোল্লা কবির নামের দুই বালু ব্যবসায়ী। ভূনবীরে রশীদ চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশের পুকুর খননের নামে অবৈধভাবে কয়েক হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করেছেন ফেরদৌস ও সিরাজ নামের দুই বালু ব্যবসায়ী। সেখান থেকে রাতের বেলা ট্রাকযোগে বালু পাচার অব্যাহত রয়েছে। একই ইউনিয়নের নতুন বাগান এলাকার আউয়াল মিস্ত্রীর বাড়ির পাশ থেকে বোমা মেশিনে বালু তুলছেন মোল্লা কবির। মির্জাপুর ইউনিয়নের বৌলাশির বাজারের পাশ থেকে বোমা মেশিন দিয়ে বালু তুলছেন এলাকার লুৎফুর, কলিমউল্লাহ ও সরকার বাজারের বালু ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়া। একই ইউনিয়নের যাত্রাপাশা এলাকার মনু মেম্বারের বাড়ির পশ্চিমে ক্ষেতের জমি থেকে মেশিন দিয়ে বালু তুলছেন বাদেআলীশা এলাকার কাওছার নামের আরও এক বালু ব্যবসায়ী। সিন্দুরখান ইউনিয়নের গোলগাঁও গ্রামের ফারুক মিয়া হামিদপুরের চা ব্যবসায়ী আলতা মিয়ার বাড়ির সামনে থেকে বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। ফলে উদনাছড়ার পাড়ের চার-পাঁচ গ্রামে ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সিন্দুরখান ও আশিদ্রোণ ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত উদনা ও বিলাস ছড়ার বিভিন্ন পয়েন্টে শহরের ব্যবসায়ী ইউছুফ আলী প্রতিদিন বালু উত্তোলনের ফলে এলাকার রাস্তাঘাটও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কথা হয় হবিগঞ্জের বাহুবল থেকে বৌলাশির এলাকার এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি জানান, দিনের চেয়ে রাত নিরাপদ বেশি। তাই রাতে চলে বেশিরভাগ বোমা মেশিন। প্রশাসনের নতুন অভিযান এড়াতে বোমা মেশিন চালাতে ‘রাতচোরা’ কৌশল নিয়েছেন তারা। শ্রমিকদের খরচসহ গাড়িপ্রতি ৬০০ টাকা করে দেওয়া হয়। আর সেই বালু বিক্রি হয় প্রায় ১ হাজার ৮শ থেকে ২ হাজার টাকায়।
ওই শ্রমিক জানান, বোমা মেশিন দু'টি কৌশলে চলে। অভিযানের খবর পেলে ওই মেশিন পানিতে ফেলে রাখা হয়। এছাড়া লতাপাতা দিয়ে ঢেকে মেশিন লুকিয়ে রাখা হয়। পরে তা সরিয়ে ফেলা হয়। মেশিনের সাইলেন্সার পাইপ পানিতে ফেলে রাখা হয়। ফলে অভিযানের সময় মেশিনটি হাতের নাগালে না পাওয়ায় প্রশাসন তা ধ্বংস করতে পারে না।
বৌলাশীরের বালু ব্যবসায়ী লুৎফুর বলেন, 'পুকুর খননের জন্য বালু উত্তোলন করছি। এখন দেখি সমস্যা। ভাই আপনার সঙ্গে আমি পরে দেখা করব।' এই বলে তিনি ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে তার সঙ্গে বালু উত্তোলনে থাকা কলিম ও সিরাজ এ কাজে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, 'শুধু আমরা নই, অনেকেই তো মেশিন লাগিয়ে বালু তুলে বিক্রি করছে।'
এলাকাবাসীর অভিযোগ, অব্যাহত বালু উত্তোলনের ফলে রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি ও কৃষিজমি ধ্বংস হচ্ছে। এসব বিষয়ে বার বার অভিযোগ করা হলেও যথাসময়ে প্রশাসন থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে দুই-একটি অভিযান হলেও জব্দকৃত বালু আবার নিলাম ডাকে ওই সিন্ডিকেট চক্র কম দামে কিনে নেয়। নিলাম ডাকের কেনা বালুকে পুঁজি করে তারা নতুন করে বুক ফুলিয়ে অবৈধ বালু বিক্রি শুরু করে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বোমা মেশিন ব্যবহার ও অবৈধ ছড়াগুলো থেকে বালু উত্তোলনের জন্য এই বালু সিন্ডিকেট চক্রটি নিজেরা মোটা অংকের টাকা আয় করছে এবং ক্ষমতাসীন বিভিন্ন মহলে প্রতিমাসে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে নিরাপদে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অনেকটা ওপেন সিক্রেট।
এসব টাকায় ভাগ বসানোয় নাম এসেছে স্থানীয় তিনজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি, কতিপয় অসাধু সাংবাদিক, পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারসহ স্থানীয় প্রশাসনের দুই-তিনজন কর্মকর্তার। আর এই বিশাল বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন শহরের নতুন বাজারের ব্যবসায়ী ইফছুফ আলী ও সাতগাঁও স্টেশন চৌমোহনার বালু ব্যবসায়ী জলিল মিয়া।
গ্রামীন এলাকায় ফসলি জমি ও পুকুর থেকে বোমা মেশিনের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলনের দীর্ঘমেয়াদী বিরুপ প্রভাব সম্পর্কে কলেজ অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস এর সহকারী অধ্যাপক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. মো. রেহান দস্তগীর বলেন, 'মাটির তলদেশের জলাধারের পানির যে সরবরাহ প্রক্রিয়া সেখানে মূল ভূমিকা পালন করে বালু। যদি মাটির তলদেশে বালু না থাকে, তাহলে মাটির নীচের অনুজ পাথর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় না। বালু না থাকলে পানির প্রবাহ কমে যাবে। ৪/৫ বছর পর দেখা যাবে এই এলাকার পানির জলাধার আরও নীচে নেমে যাবে। ফলে এলাকায় পানি উত্তোলনে সমস্যা হবে। একটা সময় হয়তো সেখানে পানিই থাকবে না।'
তিনি বলেন, 'ওইসব এলাকায় তো হাজার হাজার টন বালু তোলা হচ্ছে। ফলে অবশ্যই সেখানে ভুমিধস হবে এবং ভূমিকম্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে। একসময় ওই এলাকার মাটি দেবে যাবে। ভূমিধস হওয়ার মাত্রা শতকরা ৫০ ভাগের উপরে রয়েছে।'
বোমা মেশিনে বালু উত্তোলনের কারণে এলাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে স্বীকার করে শ্রীমঙ্গল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সম্প্রতি দু'টি অভিযান চালিয়ে জেল ও জরিমানা করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি বালু মহালগুলো ইজারা দেওয়া হয়, তাহলে আমার মনে হয় এটা রোধ করা সম্ভব হবে।'
বোমা মেশিনে বালু তোলার কারণে ভূমিধসের ঝুঁকির কথা জানানো হলে মৌলভীবাজারের নবাগত জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান আক্ষেপ করে বলেন, 'গত সপ্তাহে ওই এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের অভিযান হয়েছে। প্রয়োজনে আবার অভিযান হবে। এটা তো আসলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ। ওই এলাকার পরিবেশ রক্ষার জন্য ঝটিকা অভিযান চালাতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আমি নির্দেশনা দেব।'
জিকে/আরআর-১০