হাওররক্ষা বাঁধ : ৭ মাসেও বিল পাননি পিআইসিরা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
০৮:১০ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০
০৮:১০ অপরাহ্ন



হাওররক্ষা বাঁধ : ৭ মাসেও বিল পাননি পিআইসিরা

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার ৭ মাস গত হতে চলেছে। আর মাসখানেক পরেই শুরু হবে পরবর্তী বছরের বাঁধ নির্মাণকাজের তোড়জোড়। কিন্তু অদ্যাবধি চলতি বছরের হাওররক্ষা বাঁধের কাজের অবশিষ্ট পাওনা বুঝে পাননি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) লোকজন। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে বাদবাকি টাকা, তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। বিলম্ব বিলের কারণে ধার-দেনা করে প্রকল্প কাজে হাত দেওয়া অধিকাংশ পিআইসি এখন দিশেহারা। হাওরের বাঁধ নির্মাণে হাতের টাকা খরচ করে তিন মাস হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর সময়মতো বিল না পাওয়ায় অনেক পিআইসি এখন ক্ষোভ ঝারছেন।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের আলোচিত হাওর দুর্নীতির পর কৃষকের স্বার্থে ঠিকাধারী প্রথা বাতিল করে পিআইসি প্রথা চালু করে সরকার। কৃষকেরা নিজেদের হাওর নিজেরাই রক্ষা করবেন- এমন চিন্তা থেকে হাওরপাড়ের কৃষক দ্বারা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের মাধ্যমে সরকার হাওরকে দুর্নীতিমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই নীতিমালায় ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা আছে। সে মোতাবেক হাওররক্ষা বাঁধের কাজের শেষ সময়সীমা থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাঁধের কাজ সমাপ্তির ৭ মাস গত হতে চললেও এখন পর্যন্ত সর্বশেষ বিল পাননি পিআইসিরা। এর মাধ্যমে সরকারের কৃষকবান্ধব এ নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে বলে মনে করছেন অনেকে।

হাওরপাড়ের মানুষসহ কৃষক নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এমন খেয়ালিপনায় হাওররক্ষা বাঁধের কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন স্থানীয় কৃষকরা। এ সুযোগে বাঁধরক্ষা কাজে ভাগ বসিয়ে ফায়দা লুটে হাওরের বিপদ ডেকে আনবে সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিবাজ চক্র। পিআইসির পাওনা নিয়ে পাউবো'র দীর্ঘসূত্রিতা দেখে এর মাঝে দুরভিসন্ধিমূলক অপতৎপরতা দেখছেন তারা। হাওরপাড়ের কৃষকেরা নিজেদের বাঁধ নিজেরাই তৈরি করুক সেটা হয়তো চায় না পানি উন্নয়ন বোর্ড। যাদের বাঁধরক্ষা কাজে ত্রুটি আছে, তাদের সঙ্গে বেশিরভাগ পিআইসি যারা ঠিকমতো বাঁধ নির্মাণ করেছে তাদেরকেও কেন বিলম্বিত বিলের মাশুল দিতে হচ্ছে- এ প্রশ্ন রাখছেন সাধারণ কৃষক ও কৃষকনেতারা।

উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ৬৯টি পিআইসির অনুকূলে বরাদ্দকৃত ৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার মাঝে তিন কিস্তিতে ৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি পিআইসি আছে যেগুলো নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করায় তাদেরকে ২টি বিল দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলে অর্ধেকেরও বেশি বিল পেয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজনের। বাকি আছে আর মাত্র ১টি বিল। যেখান থেকে সরকারি ভ্যাট কর্তনের পাশাপাশি ঘাস লাগানো, দুরমুশ, জিও ট্যাক্স, মাটি ফেলাসহ আনুষাঙ্গিক কাজে ত্রুটি আছে- এমন পিআইসির পাওনা বিল থেকে ত্রুটিপূর্ণ কাজের হিসাব কষে সমপরিমাণ অর্থ বাদ দিলে বেশি পাওনা বাকি নেই বলে জানিয়েছে উপজেলা পাউবো অফিস।

এ ব্যাপারে হালি হাওরের ৫০ নম্বর পিআইসির সভাপতি জানকীনাথ চৌধুরী বলেন, 'আমাদেরকে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁধে কাজ করতে হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন ইনকোয়ারি টিমের তদারকি থাকায় আমরা ভয়ে টাকা ধার করে কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন বিল না পাওয়াতে কি যে কষ্টে আছি সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। সরকার কৃষকদের কাজ দিয়েছেন, কৃষকের কাজ কৃষক করবে, এতে কৃষকদের মাঝে একটা স্বতঃস্ফুর্ত ভাব ছিল। এখন সর্বশেষ বিল না পাওয়ায় ঋণের যন্ত্রণায় অনেক কৃষক গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হবেন।'

পাগনা হাওরের ২৪ নম্বর পিআইসির সভাপতি আলী আহমদ বলেন, 'আমি যে বাঁধে কাজ করেছি সে বাঁধ দেখতে মন্ত্রী মহোদয় এসেছিলেন। কতটা ভালো কাজ করেছি তা তিনি দেখে গেছেন। কিন্তু ১৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বিলের মধ্যে পেয়েছি ৯ লাখ টাকা। এখনও বাকি আছে ৬ লাখ টাকা। বাকি বিল না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে পারছি না। পাওনাদাররা বাড়ি-ঘর ভাঙছে। এখন আমরা কী করব?'

জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও কৃষকনেতা চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, 'হাওরে বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং হাওরের ধানও কৃষক সুন্দরমতো ঘরে তুলেছে। তারপরও কেন পিআইসিদের বিল দেওয়া হচ্ছে না? এর কারণ হতে পারে সংশ্লিষ্টদের মাঝে একটা মধ্যস্বত্বভোগী আছে যারা কাঙ্ক্ষিত পাওনা বুঝে পাচ্ছে না বিধায় বিল দিতে গড়িমসি করছে।'

বাঁধের কাজে যদি কারও কোনো ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে তা কাটছাট করে বাকি পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হোক সেই দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'পিআইসি সিস্টেমটাকে নষ্ট করে পুরোনো পন্থায় ফিরে যাওয়ার কারসাজি আছে- এমন কথা নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হয়, বর্তমান পিআইসি প্রথাকে বানচাল করে আবার পুরোনো পন্থায় নিয়ে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে।'

উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও শাখা কর্মকর্তা মো. রেজাউল কবির বলেন, 'আমরা বাঁধরক্ষা কাজ যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ফলাফল উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে প্রেরণ করে বাকি বিল পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছি। এখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন কবে নাগাদ অবশিষ্ট বিল পরিশোধ করা হবে।'

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, 'সর্বশেষ কিস্তির টাকাটা ছাড়ের জন্য গত তিন-চারদিন আগেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। প্রথমদিকে তারা একটা রিপোর্ট চেয়েছিল আমাদের কাছে। আমি এবং জেলা প্রশাসক মহোদয় দু’জনে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। আশা করছি টাকাটা দ্রুত ছাড় পাবে।'

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ ছাড় করার কোনো এখতিয়ার নেই। অর্থ ছাড় হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে এবং সেখান থেকে টাকাটা আসে পাউবোতে। কাজেই এই টাকা যদি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে না আসে, এক্ষেত্রে কিছু করার নাই। এর জন্য আমাদের জেলা প্রশাসক মহোদয়সহ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।'

 

বিআর/আরআর-০৪