‘এই মাশরাফিই আমাদের সেই মাশরাফি’

রাফিদ চৌধুরী


ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
০১:৪৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
০৬:৩৯ অপরাহ্ন



‘এই মাশরাফিই আমাদের সেই মাশরাফি’

একটি গল্প লেখা হবে। যে গল্পে একজন নায়ক থাকবেন। থাকবে ভিলেনসহ অন্যান্য চরিত্র। গল্পের নাম হবে ‘মাশরাফি’। নায়কের নামও তাই। ধারণা করুন তো, ভিলেন কে হতে পারে! সেটা আর কেউ নয়, চোট! যা মাশরাফির ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় কেড়ে নিয়েছে। ‘চোট’ নামক ভিলেন প্রতিবার আঘাত করে মাশরাফিকে, তিনিও বারবার প্রত্যাবর্তন করেন বীরদর্পে। যখন সবকিছু স্বাভাবিক তখন, আবার আঘাত হানা দেয় চোট। চোটের কারণে গতিময় বোলারের ক্যারিয়ার থেকে তাই গতি হারিয়ে গেছে। তবু লড়াই থামেনি। তিনি করে গেছেন।  

তাঁর বলে আগের মতো সেই গতি নেই। খেলার সময় সাত বার অস্ত্রোপচার করানো পা দুটোই থাকে ব্যান্ডেজে মোড়ানো। তবু তিনি লড়াই করে গেছেন। জাতীয় দলকে দিয়েছেন নেতৃত্ব। এনে দিয়েছেন অনেক সাফল্য। শেষ বেলায় শুনেছেন ‘অধিনায়কত্ব কোটায়’ খেলার খোঁচা। বিশ্বকাপে ফর্মহীনতার পর দেশে জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে ইতি টেনেছেন অধিনায়কত্বের। নেতৃত্বের শেষবেলায় অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, মাশরাফি বিন মুর্তজার সূর্য বুঝি অস্ত গেল। কিন্তু তিনি যে লড়াই চালিয়ে যাবেন, সেটা বারবার জানিয়েছেন। আর সোমবার রাতে সাক্ষাৎ জানিয়ে দিলেন ‘মাশরাফি ফুরিয়ে যায়নি’।

জেমকন খুলনার হয়ে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের কোয়ালিফায়ার ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন মাশরাফি। যা মাশরাফির টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথম। বলে গতি না থাকলেও ছিল ধার, কয়েকটিতে দেখা গেছে কাটারও। যা দেখে মনে হয়েছে ‘এই মাশারাফিই আমাদের সেই মাশরাফি’।

সোমবার রাতে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের বিপক্ষে আগে ব্যাট করে খুলনার সংগ্রহ দাঁড়ায় ২১০ রানে। ইনিংসের শেষ ওভারের ৫ম বলে মাঠে নেমেই ছক্কা হাঁকান মাশরাফি। ভক্তদের মাঝে একটি মিথ রয়েছে, ‘মাশরাফির ব্যাটে যেদিন রান আসে, বল হাতেও সেদিন তিনি উজ্জ্বল থাকেন’। সেটারই যেন প্রতিফলন ঘটল। প্রথম বলেই উইকেটের দেখা পেতেন মাশরাফি। তবে লিটনের শূন্যে তোলা বলটি তালুবন্দী করাটা আল-আমিনের জন্য কষ্টসাধ্যই ছিল। শেষ পর্যন্ত তা সীমানা পেরোয়। যদিও ওভারের শেষ বলে সৌম্য ক্যাচ তুলে দিলে শামীম তা লুফে নেন।

সেই থেকে শুরু পরের ওভারে এসেই দারুণ ছন্দে থাকা লিটন কুমার দাসকে তিনি বোল্ড করেন। একাদশতম ওভারে নিজের দ্বিতীয় স্পেলে এসে ভাঙেন মিথুন-জয়ের ৭৩ রানের জুটি। শেষ ওভারে শামসুর ও মুস্তাফিজের উইকেট যখন নিলেন, তখনই ক্যারিয়ারের পাঁচ উইকেট অর্জন হয়ে যায়। যে অর্জনে হয়েছেন ম্যাচসেরাও।

উইকেট নেওয়ার পর উল্লাস প্রকাশ করছেন ম্যাশ

 

শুরুতে বলেছিলাম ভক্তদের একটা মিথের কথা। তাঁর দুটো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম বিলেত জয়ের কথা মনে আছে? যে ম্যাচে বাংলাদেশ ৫ রানের রুদ্ধশ্বাস এক জয়ে প্রথমবার ইংরেজদের বধ করে। ২০১০ সালের সেই ম্যাচে আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ ২৩৬ রান সংগ্রহ করে। ব্যাট হাতে সেদিন মাশরাফি ২২ রান করেছিলেন। ছিল দুটি ছক্কাও। বল হাতে ৫ বোলার মিলে নেন সব কটি উইকেট। সবার মতো মাশরাফিও অর্জন করেন ২টি উইকেট। ছয় বছর পর দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে যখন ব্যাটসম্যানরা ধুঁকছিলেন, মাশরাফি তখন ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন। খেলেছিলেন ৪২ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস। বল হাতে সেদিন ৪ উইকেট পেয়েছিলেন। এরকম আরও বহু উদাহরণ আছে মিথ নিয়ে। তবে আবারও ফিরি মাশরাফির ক্যারিয়ারে।

টি-টোয়েন্টিতে এর আগে কখনও পাঁচ উইকেটের দেখা পাননি মাশরাফি। সোমবার যেটা পেলেন, সেটাও ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নে। তবে মাশরাফির ক্যারিয়ারে অন্তিম লগ্ন শব্দটি বোধহয় বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আর প্রতিবার মাশরাফি প্রমাণ করে দিয়েছেন, না সেই লগ্ন এখনও বহু দূরে। গত বিশ^কাপে ৮ ম্যাচে মাশরাফির অর্জন মাত্র ১ উইকেট। এরপর থেকেই আবারও শুরু হয় তাঁর বিদায়ের গুঞ্জন। আবারও তিনি মরিয়া হয়ে উঠেন নিজেকে প্রমাণের জন্য।

নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন তাঁর নেতৃত্বাধীন শেষ সিরিজ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও। যদিও নিজের প্রত্যাশা নিজেই মেটাতে পারেননি। তারপর করোনার থাবায় বন্ধ হয়ে যায় সবধরণের ক্রিকেট। যে থাবার ছোবলে পড়তে হয়েছে তাঁকেও। করোনা আক্রান্ত হয়েছেন স্ব-পরিবারে। করোনা থেকে সেরে উঠলেও খেলেননি বিসিবি প্রেসিডেন্ট কাপ। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপেও ছিলেন প্রথম কয়েক ম্যাচে। প্রাথমিক পর্বের শেষ দুই ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলেও, নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি। দুটিতেই পেয়েছেন ১টি করে উইকেট ও রান।

কিন্তু কোয়ালিফায়ার ম্যাচে মাশরাফি যা দেখালেন, সেটা অবিশ্বাস্য। তবে তাঁর কাছে সেটি আত্মবিশ্বাসের প্রতিদান। মাশরাফি তো এমন একটি ম্যাচই খেলতে চেয়েছিলেন। এমন ছন্দেই ফেরার চেষ্টায় মগ্ন ছিলেন বহুদিন ধরে। ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর পারফরম্যান্সের ক্ষিদে, দুটোই তাঁকে এনে দিয়েছে এই সাফল্য। যে অর্জন ক্যারিয়ারের শুরু কিংবা মাঝামাঝিতেও পাননি, তা পেলেন ক্যারিয়ার শুরুরর দেড় যুগ পর। তাই তো ২০০১ সালের সেই মাশরাফির কথাই স্মরণ করিয়ে দেন আজকের এই মাশরাফি। 

আরসি-০১/এএন-০১