প্রতিবন্ধী পরিবারের বসতভিটা কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা

শামীম আহমদ, বালাগঞ্জ


জানুয়ারি ০৮, ২০২১
০২:০২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ০৮, ২০২১
০২:০২ পূর্বাহ্ন



প্রতিবন্ধী পরিবারের বসতভিটা কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা

প্রতিবন্ধী সহোদর

প্রতিবন্ধী সহোদরের ভিটে কেড়ে নিতে নানা কূটকৌশল করছেন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রক্তের সম্পর্কীয় নিকটজনরা। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যে করেই হোক ওই বসতবাড়ি তাদের চাই। সম্প্রতি প্রতিবন্ধী সহোদরকে মারধর ও হুমকি-ধমকি দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা বাড়িতে আশ্রয় পেলেও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যরা। অর্থ ও পেশিশক্তির বলে ভিটে-মাটি দখলে নিতে মরিয়া স্বজনরা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে প্রতিবন্ধী সহোদরকে হয়রানি করছেন। এমনকি বিভিন্ন স্থানে তাদের নামে ভুয়া মামলা দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নের তাহিরপুর গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী উছমান উল্যা ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর অসুস্থ অবস্থায় সস্ত্রীক দেশে আসেন। দেশে আসার পর বিভিন্ন সময়ে একাধিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন তিনি। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি উছমান উল্যা নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। উছমান উল্যার ৩ ছেলের মধ্যে আব্দুল মাসুক ও আব্দুল ছালিক যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। আরেক ছেলে আব্দুছ ছালাম উছমান উল্যা জীবিত থাকাকালীন সময়ে মারা যান। ছালামের দুই ছেলে খালিছ মিয়া এবং লেচু মিয়া বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। উছমান উল্যার ৪ মেয়ের মধ্যে ২ জন যুক্তরাজ্যে ও ২ জন দেশে স্বামীর বাড়িতে বসবাস করছেন।

অভিযোগ উঠেছে, উছমান উল্যা মৃত্যুর আগে অসুস্থ থাকাবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির কথা বলে উছমান উল্যার ছেলে ছালিকের সহযোগীরা উছমান উল্যার স্বাক্ষর নেন। স্বাক্ষর নিয়ে ২০১৭ সালের ১২ জুন একটি হেবা দলিল করা হয় (দলিল নম্বর-১৪১৩)। পরবর্তী সময়ে উছমান উল্যার অপর ছেলে আব্দুল মাসুক ওই দলিলের বিষয়টি জানতে পেরে দলিলের কপি সংগ্রহ করেন। তাতে দেখা যায়, উছমান উল্যার মালিকানাধীন বসতবাড়ির ৩১ শতক ভূমিসহ পাশ্ববর্তী অপরাপর ভূমি মালিকগণের নামে থাকা ৭৫ শতাংশ ভূমি উছমান উল্যার ছেলে ছালিকের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। ছালিকের নামে রেজিস্ট্রি করা ওই হেবা দলিলটি আবার তার স্ত্রীর বড় ভাই মৌলভীবাজারের মিরপুর দক্ষিণ গ্রামের ইলিয়াস মাস্টারের ছেলে সিরাজুল ইসলামের নামে আমমোক্তার দেওয়া হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে উছমান উল্যার ছেলে আব্দুল মাসুক, মেয়ে জয়তেরা বিবি, মিনা বিবি এবং উছমান উল্যার মৃত ছেলে আব্দুছ ছালামের প্রতিবন্ধী দুই ছেলে লেচু মিয়া ও খালিছ মিয়া পক্ষভূত বাদী হয়ে ওই দলিলের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটের মাননীয় যুগ্ম-জেলা জজ ২য় আদালতে একটি মামলা করেন (মামলা নম্বর - ৪৩/২০)। এই মামলায় হেবা দলিলের আমমোক্তার সিরাজুল ইসলাম, তাহিরপুর গ্রামের ইদ্রিছ আলীর ছেলে তাজন আলী, আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে চুনু মিয়া, তাজপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার, ওসমানীনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), তাজপুর ভূমি অফিসের উপ-সরকারী ভূমি কর্মকর্তা, সোনালী ব্যাংক তাজপুর শাখার ব্যবস্থাপক, উছমান উল্যার ছেলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল ছালিক, মেয়ে রানা বিবি ও মিনারা বিবিকে বিবাদী এবং তৎসঙ্গে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

আদালতে মামলা দায়েরের পর উছমান উল্যার প্রতিবন্ধী দুই নাতি অর্থাৎ মৃত আব্দুল ছালামের ছেলে লেচু মিয়া ও খালিছ মিয়াকে মারধর করে গত ২০ নভেম্বর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন তাদের চাচা আব্দুল ছালিকের স্ত্রীর বড় ভাই সিরাজ ও তার সহযোগীরা। প্রতিবন্ধী দুই সহোদর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরুপায় হয়ে সমাজপতিদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেন।

বিভিন্ন মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পেরে গত ১ ডিসেম্বর রাতে ওসমানীনগর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রতিবন্ধী সহোদরকে নিজ ঘরে তুলে দেন। ওইদিন প্রতিবন্ধী সহোদরের বাড়িতে অবস্থানকারী কবির মিয়া নামের একজনকে আটক করে পুলিশ। পরদিন ২ ডিসেম্বর সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন পিপিএম প্রতিবন্ধী সহোদরের বাড়িতে গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নেন। মারধর ও হুমকি-ধমকি দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আত্মীয়দের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী লেচু মিয়া বাদী হয়ে ১ ডিসেম্বর ওসমানীনগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর-১)। এই মামলায় সিরাজ মিয়া, তাজন মিয়া, মোগলাবাজার থানার সিলাম মাঝপাড়া গ্রামের তেরা মিয়ার ছেলে কবির মিয়া, তাহিরপুর গ্রামের সফি উল্যার ছেলে লেবু মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৩-৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

গত ৮ ডিসেম্বর প্রতিবন্ধী লেচু মিয়া নিকটাত্মীয়দের সহযোগিতায় ওসমানীনগর থানায় একটি জিডি করেন (নম্বর- ৪৪৫)। ওই জিডিতে বলা হয়েছে- লেবু, তাজন ও সিরাজ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসে ৭ ডিসেম্বর প্রতিবন্ধী সহোদরকে বসতবাড়ি ছেড়ে যেতে ভয় দেখান। বাড়ি না ছাড়লে তাদেরকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জিডিতে উল্লেখ রয়েছে।

প্রতিবন্ধী সহোদরের চাচা আদালতে দায়ের করা মামলার বাদী আব্দুল মাসুক বলেন, 'আমার অসুস্থ ভারসাম্যহীন বাবার স্বাক্ষর নিয়ে আমাদেরকে না জানিয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রতারণা করে দলিল লেখক আলী আহমদ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এই দলিলটি রেজিস্ট্রি করেছেন। দলিলটি রেজিস্ট্রি হওয়ার তারিখে দলিলের গ্রহিতা ছালিক প্রবাসে ছিলেন। বাবার স্বাক্ষর ও টিপসই ব্যবহার করে ছালিকের সহযোগী সিরাজসহ অন্যান্যরা আমাদের অজান্তে বাবার পেনশনের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে আত্মসাৎ করেন। সম্প্রতি সিরাজ বাদী হয়ে আমি ও আমার প্রতিবন্ধী ভাতিজাদের নামে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সিরাজ আমার দুই প্রতিবন্ধী ভাতিজাসহ অন্যান্য ভাতিজাদের নামে বিভিন্ন স্থানে সাজানো মামলা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করছেন।'

এ বিষয়ে উছমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সিরাজ উদ্দিন খান ও আবু জাফর মোজাফ্ফর আলী বলেন, 'উছমান উল্যা মারা যাওয়ার পর তার ছেলে ছালিক পুরো বসতবাড়ির মালিকানা দাবি করেন। ছালিকের স্ত্রীর বড় ভাই সিরাজ ওই বাড়ি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মুরব্বীগণ একাধিকবার বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু সিরাজ সালিশকারীদের কথা অমান্য করে প্রতিবন্ধী দুই ভাইকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তারা বাড়িতে বসবাসের সুযোগ পান।'

আব্দুল ছালিক প্রবাসে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। ছালিকের স্ত্রীর বড় ভাই সিরাজুল ইসলামও কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ওসমানীনগর সার্কেল) রফিকুল ইসলাম বলেন, 'প্রতিবন্ধী সহোদরের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবহিত আছেন। তাদের নামে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সেটির তদন্ত কাজ শেষ হলেই প্রতিবেদন দেওয়া হবে।'

 

এসএ/আরআর-০৯