বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সংখ্যালঘু মেয়েরা

বিশেষ প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ


এপ্রিল ২২, ২০২১
০১:১০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২২, ২০২১
০১:১০ পূর্বাহ্ন



বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ সংখ্যালঘু মেয়েরা
জামিনে বেরিয়ে আবারও হুমকি

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাকাটুকিয়া গ্রামের এক বর্মণ পরিবারের বিদ্যালয়গামী ছাত্রী ও তার পরিবার এখন বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। গত ১৪ এপ্রিল বাড়িতে এসে হামলা করে ৮ জনকে আহত করেছে উত্যক্তকারীরা। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হলে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। তবে দুর্বল মামলার কারণে দুইদিনের মাথায় জামিনে বের হয়ে এসে আসামিরা এখন আবারও হুমকি-ধমকি দিচ্ছে পরিবারটিকে। এলাকাবাসীও ঘটনাটির সত্যতা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, উত্যক্তকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় আতঙ্কে আছে পরিবারটি।

তাহিরপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম টাকাটুকিয়া। মৃতপ্রায় বৌলাই নদীর পশ্চিমপাড়ের গ্রামটিতে হিন্দু-মুসলিমের যৌথ বসবাস। এই গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কয়েকশ বছর ধরে আদি নিবাসী হিসেবে বসবাস করছে পঞ্চাশোর্ধ বাছিন্দ্র বর্মণের পরিবার। তিনি আর তার দুই ভাই সত্যেন্দ্র বর্মণ ও সঞ্চিত বর্মণ একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করছেন। গ্রামের সবাই এই নিরীহ ও দরিদ্র পরিবারটিকে স্নেহ করেন। 

সরেজমিনে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, টিনশেডের একটি ঘরে বসবাস করে বর্মণ পরিবারটি। ঘরটিতে অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট। পুরাতন টিনের বেড়া ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। এই পরিবারটির বাসভবনের পেছন ঘেঁষে উপজেলা সদরে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। গ্রামের মানুষও যাতায়াত করেন এই সড়ক ধরে। এই পরিবারের তিন বোন স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। গত ২ বছর আগে পার্শ্ববর্তী টুকেরগাঁও গ্রামের ফালু মিয়ার কয়েকজন নাতির দৃষ্টি পড়ে ওই পরিবারের ছাত্রীদের ওপর। বর্মণ পরিবারটি যুবকদের পরিবারকে বিষয়টি অবগত করলেও তারা পাত্তা দেননি। তাই যুবকরা আরও বেপরোয়া হয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে এবং সদর সড়ক হওয়ার সুযোগ নিয়ে সবসময় তিন ছাত্রীকে উত্যক্ত করে আসছিল। মেয়েরা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ও তারা উঁচু গলায় খিস্তিখেউড় করে থাকে।

একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রাম্য শালিস ডাকা হলে শালিসে শহিদ মিয়ার ছেলে রুহিত মিয়া, বিল্লাল মিয়ার ছেলে মুসা মিয়া, লাসি মিয়া, কালাম মিয়া, মুক্তার মিয়ার ছেলে কাশেম মিয়া, সিরাজ মিয়ার ছেলে মেজর মিয়া ও তাদের আত্মীয় পাবেল মিয়া দোষী প্রমাণিত হয়। কয়েকমাস আগে স্থানীয় শালিসকারীরা বর্মণ পরিবারকে আইনের আশ্রয় না নিতে অনুরোধ করে উত্যক্তকারীদের শালিসে কান ধরে উঠবস করান। কিন্তু শালিসের এই শাস্তিতে ক্ষুব্ধ হয় ওই যুবক ও তাদের স্বজনরা। তারা শালিসের পর সত্যেন্দ্র বর্মণের মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপকরণ জালগুলো পুড়িয়ে দেয়। খড়ের গাদায়ও আগুন ধরিয়ে দেয়। এভাবে হুমকি-ধমকি ও ভীতি প্রদর্শণ করে আসছিল নানাভাবে।

গত ১৪ এপ্রিল দুপুরে বিল্লাল মিয়ার নেতৃত্বে উত্ত্যক্তকারী তার তিন ছেলে ও ভাতিজাসহ আত্মীয়-স্বজনরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হঠাৎ বর্মণ পরিবারে হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র নিয়ে কুপিয়ে আহত করে সঞ্চিত বর্মণ, দেবেন্দ্র বর্মণ, বাবলু বর্মণ, বাচিন্দ্র বর্মণ ও বিউটি রাণী বর্মণসহ ওই পরিবারের ৮ জনকে। এ ঘটনার খবর পেয়ে এলাকার প্রতিবাদী মানুষজন গিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। পুলিশসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। এ ঘটনায় ওইদিন থানায় মামলা দায়ের করেন সত্যেন্দ্র বর্মণ। পুলিশ ওইদিন হামলাকারী এজাহারভুক্ত আসামি সিরাজ মিয়া ও শহিদ মিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। গ্রেপ্তারের দুইদিন পরই দুর্বল মামলার কারণে আসামিরা বেরিয়ে এসে এখন প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এখন ওই পরিবারটি নিরাপত্তাহীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন অসহায়রা।

মামলার বাদী সত্যেন্দ্র বর্মণ বলেন, 'আমরা গরিব অসহায় পরিবার। গ্রামের কারও সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। আমাদের তিনটি মেয়ে স্কুলে যায়। গত দুই বছর ধরে বিল্লালের ছেলেরা ও তার ভাতিজারা আমাদের মেয়েদের উত্যক্ত করছে। বাড়ির পাশে রাস্তা থাকায় সবসময় আমাদের মেয়েদের উদ্দেশ্য করে খারাপ কথা বলছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। শালিসে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর আমাদের বাড়িতে এসে তারা হামলা করেছে। এখন জেল থেকে বেরিয়েও হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।'

সত্যেন্দ্র বর্মণের প্রতিবেশী টাকাটুকিয়া গ্রামের শাহারুল ইসলাম বলেন, 'বিল্লাল মিয়া, তার ছেলে ও ভাতিজারা দুশ্চরিত্রের। তারা এই নিরীহ বর্মণ পরিবারের মেয়েদের সবসময় উত্ত্যক্ত করছে। বিচারে তারা দোষীও প্রমাণিত হয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল তারা বাড়িতে এসে হামলা ও মারধর করেছে। এত বড় ঘটনা ঘটিয়েও তারা জেল থেকে বেরিয়ে এখন ওই অসহায় পরিবারকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।'

আরেক প্রতিবেশী আকরাম হোসেন বলেন, 'টুকেরগাঁও গ্রামের রোহিত, কাসেম, শহিদ, মুসা মিয়া ও পাভেলসহ কয়েকজন যুবক বর্মণ পরিবারের ছাত্রীদের উত্যক্ত করছে। ওই পরিবারের ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারে না। রাস্তায় বের হতে পারে না ওদের ভয়ে। আমরা বেশ কয়েকবার তাদের বিচার করেছি। এর জের ধরে গত ১৪ এপ্রিল তারা বাড়িতে এসে হামলা করেছে। আমরা কয়েকজন তাদেরকে শত চেষ্টা করেও আটকাতে পারিনি। রামদা, ছুরি, রড দিয়ে ওই পরিবারের নারী-পুরুষদের মারধর করেছে। এত বড় অপরাধ করেও এখন জেল থেকে বেরিয়ে আবারও পরিবারটিকে হুমকি দিচ্ছে।'

তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল লতিফ সরদার বলেন, 'আক্রান্ত পরিবারটি যেভাবে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন আমরা সেভাবেই অভিযোগটি গ্রহণ করেছি। আমরা প্রতিদিন নিরীহ পরিবারটির খবর নিচ্ছি এবং অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। জেল থেকে বেরিয়ে তাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে আমরা এমন অভিযোগ পাইনি।'

 

এসএস/আরআর-০৯