হাকালুকিতে ধান কাটা শুরু, শ্রমিক সংকটে বেড়েছে ব্যয়

জিয়াউল হক জিয়া, কুলাউড়া


এপ্রিল ২৩, ২০২১
১২:৪৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৩, ২০২১
১২:৪৫ পূর্বাহ্ন



হাকালুকিতে ধান কাটা শুরু, শ্রমিক সংকটে বেড়েছে ব্যয়

নানারকম উদ্বেগ-উৎকন্ঠা নিয়ে হাকালুকি হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু করেছেন কৃষকরা। প্রায় প্রতিদিনই ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি পাহাড়ি ঢলে একদিনেই তলিয়ে যেতে পারে পুরো হাওরের ধান। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলকে ছাপিয়ে রমজান মাসে করোনার প্রাদুর্ভাব হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ধান ঘরে তোলার ক্ষেত্রে। দেশে করোনার সংক্রমণ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়ায় চলছে লকডাউন। এতে ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত শ্রমিক। এমন প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির পাড়ে চলছে উৎসবমুখর পরিবেশে বোরো ধান কাটা। তবে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় হতাশ কৃষকরা।

হাওরপাড়ের সকল উপজেলায় পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষায় আগাম ধান কাটার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। হাওরপাড়ের বড়লেখা উপজেলায় গত সোমবার উপজেলা কৃষি অফিস কর্তৃক বোরো ধান কাটার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে কৃষকদের এ পরামর্শ দেওয়া হয়।

সরেজমিনে হাকালুকি হাওরের ধলিয়া বিল, কুলাউড়া উপজেলার অংশে ভুকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুর, মীরশঙ্কর ও গৌড়করণ এলাকায় গেলে ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোসহ বোরো ধান নিয়ে কৃষকদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়। রমজান মাস হওয়ায় কৃষক নিজে ধান কাটতে পারলেও সেই ধান জমি থেকে মাড়াই করার স্থানে নিয়ে যেতে শ্রমিক ব্যবহার করতে হচ্ছে।

সাদিপুর গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া (৭০) জানান, ৮ কিয়ার (বিঘা) জমিতে বোরোধান রোপণ করেছেন তিনি। রোজা থাকার কারণে ও বয়সের ভারে তিনি নিজে ধান কাটতে পারছেন না। ৫ জন ধান কাটার শ্রমিক লাগিয়েছেন। কিন্তু তারা প্রতিদিন আধা বিঘা জমির ধানও কাটতে পারছেন না। অথচ ৩ বেলা খাবার দিয়েও তাদেরকে দিতে হয় প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে। ফলে ৫ শ্রমিকের প্রতিদিনের খাবারসহ তার খরচ পড়ছে কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। তারা ২ দিনে এক বিঘা জমির ধান কাটলে বিঘাপ্রতি খরচ হচ্ছে ৬ হাজার টাকা। এরপর ধান মাড়াইসহ আছে অন্যান্য খরচ। এই ধানের উপর নির্ভরশীল তার ৬ জনের পরিবার। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও প্রতি মণ ধানে খরচ হচ্ছে ১ হাজার টাকা। অথচ হাওরে ধান বিক্রি করলে প্রতি মণ ধান ৪ থেকে ৫শ টাকার বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়।

কৃষক সালাউদ্দিন ২২ বিঘা জমিতে, জমসেদ আলী ১২ বিঘা জমিতে ও আব্দুস সালাম ৬ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। তারা জানান, এবার চৈত্র মাস থেকে বৃষ্টিপাত হওয়ায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। গত পহেলা বৈশাখের দিন থেকে ধান কাটা শুরু করেছেন তারা। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। তবে ধান কাটার শ্রমিকের খরচ বেশি হওয়ায় তারা হতাশ। এছাড়া করোনার কারণে শহরে গিয়ে সময়মতো তেল আনা সম্ভব নয়- এ অজুহাতে মাড়াই মেশিনেও খরচ দিতে হচ্ছে বেশি। পহেলা বৈশাখ থেকে প্রায় প্রতিদিন রাতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় পাহাড়ি ঢলে বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে কৃষকরাও রয়েছেন উদ্বেগ-উৎকন্ঠায়।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার হাওরে বিআর-১৪, বিআর-২৮, বি-২৯, বি-৫৫, বি-৫৮, বি-৬৫, বি-৭৪, বি-৬৯, বি-৬৭, বি-৭৯, বি-৮৪, বি-৮৮, বি-৮৯ ও বি-৬৩ সহ মোট ১৭ জাতের ধান রোপণ করেছেন কৃষকরা। এছাড়া ৫ জাতের হাইব্রিড ময়না, এসএলএইচ, টিয়া, হিরা-২, রূপালি বোরো ধান চাষ করেছেন কৃষকরা। সকল জাতের ধানেরই বাম্পার ফলন হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মুমিন জানান, হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া উপজেলা অংশের ৬টি ইউনিয়নে মোট ৭ হাজার ৯১২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে, যা কৃষকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। রমজান মাস থাকায় বোরো ধান কাটতে শ্রমিক সংকট যাতে না হয়, সেজন্য চা-বাগানের শ্রমিকদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কৃষি বিভাগ শ্রমিক দেওয়ার পাশাপাশি ধান কাটা ও মাড়াই করতে কৃষকদের ৫টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দেবে। একেকটি মেশিন ঘণ্টায় ১ একর জমির ধান কাটতে পারে। ফলে কৃষকরা কম খরচে ও তুলনামূলক কম সময়ে বেশি ধান কাটতে পারবেন।

কুলাউড়া উপজেলা ছাড়াও এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরতীরের মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী ও বড়লেখা এবং সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায় বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। কৃষি অফিসের তথ্যমতে, কেবল হাওরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়ে থাকে। হাওরে মাছের পরে ধানই হচ্ছে মানুষের জীবিকায়নের অন্যতম মাধ্যম। আগাম পাহাড়ি ঢলে ক্ষতি না হলে বোরো ধান মানুষের সারা বছরের খাদ্যের ঘাটতি পূরণ করে।

 

জেএইচ/আরআর-০৯