হবিগঞ্জে এক মাসে অর্ধডজন হত্যাকাণ্ড

সাইফুর রহমান তারেক, হবিগঞ্জ


জুন ১৪, ২০২১
০৮:১৬ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১৪, ২০২১
০৮:১৬ অপরাহ্ন



হবিগঞ্জে এক মাসে অর্ধডজন হত্যাকাণ্ড

হবিগঞ্জ জেলায় ৩০ দিনে মধ্যে ৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জ সদর, নবীগঞ্জ এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় একটি করে খুন হলেও শুধু বানিয়াচং উপজেলায় ঘটেছে ৩টি খুনের ঘটনা। মামীর হাতে ভাগ্নে, ভাগ্নের হাতে মামা, ছেলের হাতে মা, ছোটদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে বড়দের সংঘর্ষ, বিয়ের আলোচনায় আমন্ত্রণ না পাওয়ার ক্ষোভে হবু বরকে খুন ও হাতাহাতির জেরে দুইপক্ষের সংঘর্ষে এসব হত্যার ঘটনা ঘটে। আর এর কারণ হিসেবে নৈতিক অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন পুলিশসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ মে সন্ধ্যায় আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকাইলছেও বাজারে শের আলী এবং কামাল মিয়া নামে দুইজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরদিন সকালে উভয়পক্ষের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে কামাল মিয়া নিহত ও অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষ আহত হন। পুলিশ দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত ৩৪ জনকে আটক করে।

১২ মে বানিয়াচং উপজেলার পুরান পাথারিয়া গ্রামের কালু মিয়া ও তার চাচাতো মামা জাহির মিয়ার মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এর জেরে ফিকলের আঘাতে মামা কালু মিয়া আহত হন। পরে তাকে হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত ব্যক্তির ভাগ্নে অভিযুক্ত জহিরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

গত ১৯ মে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শৈলজুড়া গ্রামে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে সজিব মিয়া নামের এক যুবক খুন হন। ঘটনার পর উজ্জ্বল মিয়া নামের এক যুবক সজিবকে খুন করেছেন বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সজিবের সঙ্গে উজ্জ্বলের শ্যালিকার বিয়ের আলোচনা চলছিল। এ আলোচনায় বড় জামাই হিসেবে নিমন্ত্রণ না পাওয়ার ক্ষোভ থেকেই উজ্জ্বল খুন করেছেন বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন।

২৩ মে শিশুদের ফুটবল খেলা নিয়ে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে নবীগঞ্জ উপজেলার কলাবরপুর গ্রামে আবুল মিয়া ও আব্দুল মতিনের পরিবারের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দিলবর মিয়া নামের এক ব্যক্তি নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনায় ফারুক মিয়া নামের একজনকে নবীগঞ্জ থানার পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

২৬ মে বানিয়াচং উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী ও আব্দুল বারিক নামে দুইজনের বিরোধ মীমাংসায় একটি সামাজিক বিচার বসে। এ সময় দুইপক্ষের সংঘর্ষ হলে ফিকলের আঘাতে মোহাম্মদ আলীর মা বৃদ্ধ গোলাপজান বিবি মারা যান এবং পুলিশ মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করে। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোহাম্মদ আলী জানান, প্রতিপক্ষের লোকজনকে ফাঁসাতেই ফিকলের আঘাতে নিজের মাকে হত্যা করেছেন তিনি।

২৭ মে বানিয়াচং উপজেলার আদর্শ গ্রামের জলাশয় থেকে মোহাম্মদ আলী নামের তিন মাস বয়সী শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে হত্যার দায় স্বীকার করে ওই শিশুর মামী তুলনা বেগম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন, শিশুটিকে ঘরের বিছানায় রেখে তার মা পার্শ্ববর্তী বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন। এ সুযোগে তুলনা বেগম শিশু মোহাম্মদ আলীকে জীবিত অবস্থায় জলাশয়ে ফেলে দেন। শিশু মোহাম্মদ আলীর নানী (তুলনার শাশুড়ি) মোহাম্মদ আলীকে তার একমাত্র মেয়ের চেয়ে বেশি আদর করতেন। এজন্য তুলনার হিংসা হতো। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, সমাজে সুস্থ চিন্তা চর্চা এবং উন্নত মননশীলতার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে সমাজে এখন খুন-খারাবির মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। লোভ-লালসা ও হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়ে মানুষে মানুষে মায়া-মমতা কমে গেছে। এসব থেকে বের করা পুলিশের পক্ষে একা সম্ভব নয়। আমাদেরকে সকল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে গ্রাম্য রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। শিক্ষার হার যত বাড়বে, গ্রাম্য দাঙ্গা তত কমবে।    

হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও প্রশিকিউশন) শৈলেন চাকমা বলেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে অধিকাংশ গ্রাম্য দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটছে। এগুলো বন্ধ করা পুলিশের পক্ষে একা সম্ভব নয়। জনপ্রতিনিধি, এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সুশীল সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম করতে হবে। আমরা সকলে মিলে কাজ করলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব গ্রাম্য দাঙ্গা বন্ধ করা সম্ভব হবে। এজন্য জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশে অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে পুলিশ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে এবং অনেকে স্বেচ্ছায় অস্ত্র জমা দিয়ে আর দাঙ্গায় জড়াবে না বলে অঙ্গিকার করেছে। 


এসআর/আরআর-০৮