ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিতে হরিলুট, প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা

মাহবুব আলম, ছাতক


জুলাই ১৭, ২০২১
১০:২০ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১৭, ২০২১
১০:২৬ অপরাহ্ন



ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিতে হরিলুট, প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা

১৯৩৭ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সিমেন্ট কারখানা ছাতক সিমেন্ট কোম্পানির নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও স্থায়ীত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ছাতক সিমেন্ট কারখানার আধুনিকায়নে ব্যালেন্সিং মডার্নাইজেশন রেনোভেশন অ্যান্ড অ্যাক্সপেনশন (বিএমআরই) প্রকল্পের প্রায় হাজার কোটি টাকা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে হরিলুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের প্রেক্ষিতে বিসিআইসি'র উচ্চপর্যায় থেকে বেশ কয়েকটি তদন্ত চলমান রয়েছে। তবে ওই সিন্ডিকেটের হাত এতই শক্তিশালী যে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া যে কোনো সংস্থাকে তারা ম্যানেজ করার ক্ষমতা রাখে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, এই কারখানায় উৎপাদন ডায়মন্ড ব্র্যান্ডের সিমেন্টের চাহিদা দেশের বাইরেও রয়েছে। অতীতে কারখানা আধুনিকায়নের উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো কারখানাটি বেসরকারিকরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিল্প মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওয়েট প্রসেস থেকে কারখানাটিকে ড্রাই প্রসেস প্রকল্পে রূপান্তর করতে ২০১৬ সালে ৮ মার্চ একনেকে আধুনিকায়ন ড্রাই প্রসেস প্রকল্পের অনুমোদন হয়। চীনের নানজিং সি-হোপ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ৮৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু করে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক বরাবরে ছাতকের আব্দুর রশীদ নামের এক ব্যক্তির দেওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, নানজিং সি-হোপ মূল কাজটি পেলেও এর মূলহোতা হিসেবে রয়েছেন বিসিআইসি'র বিভিন্ন প্রকল্পে কালো তালিকায় থাকা ড. নাজির মো. খান। তিনি চায়নিজ কোম্পানির এ দেশীয় কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে দ্বায়িত্বে রয়েছেন। পূর্বে ঘোড়াশাল সার কারখানায় কন্ট্রোল বাল্ব ক্রয়ের জন্য একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশগ্রহণ করেন নাজির মো. খান। টেন্ডারে তিনি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ক্রয়াদেশ পান। বাল্ব সাপ্লাইয়ের কয়েকদিন পরেই এগুলো সিজ হয়ে যায় এবং কারখানার উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়। ওইসময় তার ফার্ম এম এম সার্ভিসকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিসিআইসি। আরও অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের বিএমআরই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করে ৮০ কোটি টাকা বিল উত্তোলন করে চায়নিজ কোম্পানি উহান সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন তাদের তৎকালীন দেশিয় এজেন্ট নাজির মো. খান। পরবর্তীতে বন্ধই হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।

একইভাবে ছাতক সিমেন্ট কারখানার বিএমআরই প্রকল্পের আওতায় এক্সেভেটর, এয়ার কম্প্রেশার, ড্রাম ট্রাক, ফ্রক লিফটার, লকোমেটিভ ইঞ্জিন, হুইল লোডার ক্রয়ের তিনটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে সেই নাজির মো. খানের আরও দুইটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মেশিনারিজ ও সেকনিক বাংলাদেশ। তিনটি টেন্ডারেই তার প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়। নিম্নমানের মেশিনারিজ সরবরাহ করেও কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এগুলোর মান যাচাইয়ে পার পেয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে এক বছরের মাথায় এগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তিনটি টেন্ডারের সঙ্গে স্থানীয় কিছু কাজ করানোর শর্ত যেমন ১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কথা থাকলেও এগুলো না করেই বিল নিয়ে চলে যায় তার প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া ছাতক সিমেন্ট কারখানার নতুন প্রকল্প তদারকি করার জন্য ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। পরামর্শকরা প্রকল্প পরিদর্শন না করেই কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে নিয়মিতই বিল তুলে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। চায়নিজ কোম্পানির কাছ থেকে নির্দিষ্ট একটা অংক ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের সবগুলো কাজ করার একটা চুক্তি করেন নাজির মো. খান। এতে চায়নিজ কোম্পানিকে মোটা অংকের লাভ দেখান তিনি। পরে কমিশন নিয়ে অনভিজ্ঞ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানির কাছে সাব-কন্ট্রাক্ট দেন নাজির মো. খান। ঠিকাদাররা নিম্নমানের মালামাল দিয়ে কাজ করে নিয়মিত বিল তুলে নিচ্ছেন তিনি। যেমনটি হয়েছিল চট্টগ্রাম কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের ক্ষেত্রে। ছাতক সিমেন্ট কারখানার বিএমআরই প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ও জাপানিজ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করার কথা থাকলেও প্রকল্পের পরিচালক ও কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এম বারী ও বিসিআইসি'র পরিচালক লুতফুর রহমানকে ম্যানেজ করে চায়নিজ কোম্পানি মালামাল সরবরাহ করছে। ইতোমধ্যেই একটি কিলনের মূল্য নিয়েছে ৭০ কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে চায়নিজ এ কিলনটির মূল্য ২০ কোটি টাকা।

এদিকে কার্যাদেশ অনুযায়ী ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভার্টিক্যাল বয়লার আনার কথা থাকলেও মাত্র ৬ কোটি টাকা মূল্যের কোনো ধরনের ড্রয়িং অ্যাপ্রুভাল ছাড়াই একটি হরিজেন্টাল বয়লার নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া প্রজেক্টের সকল কাজে দুবাই থেকে আমদানি করা উন্নতমানের পাথর ব্যবহার করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যেই সাড়ে ১০ হাজার টন পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ২ হাজার ৬০০ টন দুবাই থেকে আমদানি করা। বাকিগুলো চুনাপাথর। নিম্নমানের চুনাপাথর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাওয়ার প্ল্যান্ট কিলনের কাজ করা হয়েছে। ফলে প্ল্যান্টের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে যে কোনো সময় চুনাপাথর গলে কোম্পানির বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এসব কাজ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ছাতক সিমেন্ট কারখানার সিবিএ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস। তিনি জানান, স্থানীয়ভাবে কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য কোনো কমিটি করা হয়নি। যার কারণে তারা ইচ্ছামতো কাজ করছে।

আব্দুল কুদ্দুস বলেন, দেশে এর আগেও কয়েকটি কোম্পানি আধুনিকায়নের পর কিছু দুর্নীতিবাজের কারণে দুই-এক বছর পরেই বিকল হয়ে গেছে। ছাতক সিমেন্ট কারখানা আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং হাজারও শ্রমিকের বেঁচে থাকার সম্বল। যে কোনো উপায়ে এটিকে রক্ষা করতে হবে।

এ ব্যাপারে প্রকল্পের পরিচালক ও কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এম বারী জানান, কিছু অভিযোগ তিনি শুনেছেন। কয়েকটির তদন্ত চলছে।

চুনাপাথর দিয়ে কাজ করানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।


এমএ/আরআর-০৪