শামীম আহমেদ, ধর্মপাশা
জুলাই ৩০, ২০২১
০১:০৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুলাই ৩০, ২০২১
০২:৪৫ পূর্বাহ্ন
আইন-কানুনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের পিপড়াকান্দা গ্রামের খানিকটা দক্ষিণপাশে থাকা বন্দোবস্তকৃত ৩ একর ৬২ শতক সরকারি খাস কৃষিজমির চারদিকে লাল পতাকা সম্বলিত শতাধিক বাঁশের বেষ্টনি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় মধ্যনগর বাজার সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদী থেকে মাটি উত্তোলন করে সেই মাটি বন্দোবস্তকৃত খাস জমিতে ফেলে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করার পাঁয়তারা চলছে। খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তিদেরকে ম্যানেজ করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র এ কাজে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের পিপড়াকান্দা গ্রামের খানিকটা দক্ষিণপাশে ৩ একর ৬২ শতক সরকারি খাস বোরো জমি রয়েছে। এই জমি থেকে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের পিপড়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা বরুন চন্দ্র সরকারকে ১ একর, একই গ্রামের ভূপেন্দ্র সরকারকে ১ একর ১২ শতক এবং একই ইউনিয়নের গলইখালী গ্রামের দেবেন্দ্র চাকলাদার ১ একর ৫০ শতক খাস ভূমি ৯৯ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। চলতি ১৪২৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহে ওই বন্দোবস্তকৃত জায়গায় ভবন নির্মাণের জন্য ১২টি আরসিসি পিলার নির্মাণ করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময়ে বন্দোবস্তকৃত কৃষিজমির চারদিকে লাল পতাকা সম্বলিত শতাধিক বাঁশ পুতে দিয়ে বেষ্টনি নির্মাণ করা হয়।
ওই কৃষিজমির কবুলত দলিলে উল্লেখ রয়েছে, বন্দোবস্তকৃত কৃষিজমিতে কৃষিকাজ করা ছাড়া সেখানে অন্য কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। মাটি ফেলে কৃষিজমি ভরাট করা যাবে না। এমনকি বন্দোবস্ত পাওয়া কৃষিজমি কারও কাছে বিক্রি, হস্তান্তর ও শ্রেণিও পরিবর্তন করা যাবে না। বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তিরা এই জমিতে নিজেরাই কৃষিকাজ করবেন এবং বর্গাচাষিকে দিয়ে সেখানে চাষ করা যাবে না।
এসব শর্ত থাকলেও বন্দোবস্তকৃত জমিতে মাটি ভরাটের জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্যনগর বাজার লাগোয়া সোমেশ্বরী নদীতে একটি ড্রেজার মেশিন ফেলে রাখা হয়েছে। স্থাপনা নির্মাণের জন্য সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ১০/১২টি আরসিসি পিলার। কাগজে-কলমে কৃষিজমি বন্দোবস্ত পাওয়া লোকজনের নাম ব্যবহার করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী চক্র এতে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পিপড়াকান্দা গ্রামের বরুন চন্দ্র সরকার বলেন, আমি যে জায়গাটি বন্দোবস্ত পেয়েছি সেই জায়গায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ম্যাংগো গ্রুপ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। এই ব্যবসায় অনেকেই পার্টনার রয়েছেন। বন্দোবস্তকৃত কৃষিজমি সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদী থেকে মাটি তুলে আপাতত বন্দোবস্তকৃত জায়গাটি ভরাট করব।
বন্দোবস্তকৃত জায়গায় মাটি ভরাট ও স্থাপনা তৈরি করার নিয়ম নেই জানেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মধ্যনগর বাজারে অনেকেই বন্দোবস্তকৃত জায়গায় স্থাপনা তৈরি করে সেখানে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে আসছেন। এ নিয়ে তো কেউ কিছু ব্লছে না। তাহলে আমি করলে দোষ কেন?
খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া পিপড়াকান্দা গ্রামের বাসিন্দা ভূপেন্দ্র সরকার মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। তার ছেলে ভজন সরকার বলেন, আমরা যে জায়গাটি বন্দোবস্ত পেয়েছি তাতে বোরো ধান চাষ করে একটি বছরও বোরো ফসল ঘরে তুলে আনতে পারিনি। ফসল পাকার আগেই সেই স্থানে পানি চলে আসে। তাই চারদিকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে বন্দোবস্ত পাওয়া জায়গাটি চিহ্নিত করেছি। ১০/১২টি পিলার সেখানে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। আপাতত সোমেশ্বরী নদী থেকে মাটি তুলে কৃষিজমিতে ফেলে তা ভরাট করা হবে। এরপর ভবিষ্যতে সেখানে কী করব তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
বন্দোবস্ত পাওয়া গলইখালী গ্রামের বাসিন্দা দেবেন্দ্র চাকলাদার বলেন, জায়গাটি একটি প্রভাবশালী পক্ষ কিনে নিতে চাইছে। আমি সেটি এখনও বিক্রি করিনি।
মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে মধ্যনগর বাজার সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদীতে একটি ড্রেজার মেশিন পড়ে আছে। বন্দোবস্তকৃত জায়গাটিতে বাঁশ পুঁতে লাল পতাকা টানিয়ে চারদিকে বেষ্টনি দেওয়া হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি, এখানে মাটি ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করা হবে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। এসব কাজের নেপথ্যে প্রভাবশালীরা জড়িত রয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তাই প্রশাসন বিষয়টি খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
মধ্যনগর ইউনিয়নের জমশেরপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা সুধীর সরকার বলেন, আমাদের ইউনিয়নের মধ্যনগর বাজারটি উপজেলার অতি প্রাচীন বাজার। এই বাজার সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদী রয়েছে। এই নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন করে বন্দোবস্ত ওই খাস কৃষিজমিতে ফেলে সেটি ভরাট করা হবে বলে শুনতে পাচ্ছি। ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন করা হলে মধ্যনগর বাজারটিসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রাম ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে আমি মাসখানেক আগে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মহেদয়ের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছি।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রেদুয়ানুল হালিম বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। বন্দোবস্তকৃত জায়গা ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করা অবৈধ। পিপড়াকান্দা গ্রামের দক্ষিণপাশে খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া সংশ্লিষ্টদেরকে আগামী রবিবার বন্দোবস্ত সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্রাদি নিয়ে আমার কার্যালয়ে আসতে বলেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনতাসির হাসান বলেন, বন্দোবস্তকৃত কৃষিজমিতে মাটি ফেলে ভরাট করা ও স্থাপনা তৈরি করার কোনো নিয়ম নেই। এমনকি বন্দোবস্তকৃত জায়গা অন্য কারও কাছে হস্তান্তর ও বিক্রি করা যাবে না। তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসএ/আরআর-০৮