হকনগর শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ : রক্তের স্মৃতি ছোঁয়া উপত্যকা

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী, দোয়ারাবাজার


সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১
১১:২০ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১
১১:২০ অপরাহ্ন



হকনগর শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ : রক্তের স্মৃতি ছোঁয়া উপত্যকা

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মহান মুক্তিযুদ্ধর গৌরবগাথা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হকনগর (বাঁশতলা) শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ। এখানকার চারদিকে সবুজের সমারোহ বিমোহিত করে। পাহাড়ি মনোরম দৃশ্য রুচিশীল প্রকৃতিপ্রেমীদের মন কেড়ে নেয়। পড়ন্ত বিকেলে পাখির কলরব ও সবুজ বাতাসের মন মাতানো শব্দ প্রাণ জুড়ায়। ওপারে সুউচ্চ পাহাড় আর এপারের সীমানায় ছোট-ছোট টিলা, নদীর নয়নাভিরাম জলকেলি আর পাহাড়ে সাজানো বিস্তীর্ণ এলাকার মনোহর দৃশ্য মন ছুঁয়ে যায়। সময়ের বিবর্তনে হকনগর যেন রক্তের স্মৃতি ছোঁয়া এক কবিতার উপত্যকা হয়ে উঠেছে। 

স্মৃতিসৌধের প্রবেশপথে হকনগর মৌলা নদীর উপর নির্মিত স্লুইসগেটটি বিমোহিত করার মতো একটি জলপ্রবাহ। পাহাড়ি ঝরনার মতোই এ স্লুইসগেট আলাদা সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। স্লুইসগেট বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানির শন শন শব্দে পুরো এলাকাই মুখর হয়ে থাকে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা এখানকার শীতল জলে সাঁতার কেটে সহজেই শরীরের ক্লান্তি দূর করেন আগত পর্যটকরা।

স্লুইসগেট ছাড়িয়ে অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে ত্রিভুজ আকৃতির শহীদ মিনার। পাহাড়ঘেঁষা মৌলা নদীর তীরের শহীদ মিনার এলাকাটি এখন সুনামগঞ্জের অন্যতম পর্যটন এলাকা। সম্প্রতি এখানে নির্মিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’। এখানকার পরিবেশ খুবই শান্ত ও মনোরম। সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশ থেকে নেমে আসা সাদা মেঘের মিতালী দেখে মনে হবে যেন আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে আছে। নির্জন সবুজ সমতলে একাত্তরের বীরত্বগাথা স্মৃতি নিয়ে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার।

এই শরতে শহীদ মিনারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা মিলবে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশবন। সবুজ-সমারোহে সাদা কাশফুলেরা হেলেদুলে যেন সাঁতার কাটে। উজানী নদীর কিনারে বসতবাড়ির আঙিনায়ও গজিয়ে উঠেছে কাশফুল। দূর থেকে অপলক তাকালে দেখা যাবে, ওপারের সীমানায় পাহাড়ে নেমে আসা মেঘমালা আর সমতলে সবুজ অবগাহনে সাদা কাশফুলের অনন্য সখ্যতা। এখানকার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে যে কারোর মন ভরে যায় অনায়াসে।

শহীদ মিনার ঘুরে আসার পথে ভারতীয় সীমানার কোল ঘেঁষে বাংলাদেশের জুমগাঁও গারো পাহাড়ের (টিলা) অবস্থান। এটি অন্তত ২০০ বছরের পুরোনো আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রাম। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে পাহাড়সম ওই টিলা বর্তমান বাংলাদেশের সীমনায় পড়ে। পরবর্তীতে গ্রামের নামকরণ করা হয় জুমগাঁও। জানা যায়, এককালে এখানে ব্যাপকভাবে জুম চাষ করতেন আদিবাসীরা। এই গ্রামে বর্তমানে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের অন্তত ২৫টি পরিবার বসবাস করছে। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করতে প্রতিদিনই প্রকৃতিপ্রেমীরা শহীদ মিনার ঘুরে এসে এই গ্রামে জড়ো হন। 

হকনগর শহীদ মিনার এলাকাটি মুক্তিযুদ্ধকালীন ৫ নম্বর সেক্টরের সেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল। দেশ স্বাধীনের বহু বছর পর ১৯৯৮ সালে এখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখতে সাব-সেক্টর কমান্ডার এ এস হেলালউদ্দিন তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেন। এর নকশা করেন বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আর্কিটেক্ট আমির হোসেন। পাশেই লাল-সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ জন শহীদের সারিবদ্ধ কবর। নিকটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁরই অন্যতম সহচর জননেতা আবদুল হক (এম এন এ হক) এর যৌথ ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ এখানে স্থানান্তরিত করা হয় ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা জননেতা আবদুল হক (এম এন এ হক) এর কবর। তাঁর নামেই এখানকার নামকরণ করা হয়েছে ‘হকনগর’। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টরে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, ক্যাপ্টেন আকবর হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী, আবদুল হালিম, আবদুল মজিদ এবং বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবি (নন গেজেট) ‘বীরপ্রতিক’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।   

এখানে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার পর সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের আান্তরিক প্রচেষ্টা ও তাঁরই উদ্যোগে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণ ও উন্নয়নসহ এখানে একটি নান্দনিক রেস্টহাউজ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। হকনগর (বাঁশতলা) এলাকাকে একটি অত্যাধুনিক পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখানে উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রয়েছে। ২০২১ সালে শহীদ মিনারের পাশেই নির্মিত হয়েছে আরও একটি নান্দনিক ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’। এই শরতে শহীদ মিনার ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ এলাকায় প্রতিদিনই পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়। নতুন নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধটি ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই আড্ডায় মেতে ওঠেন স্থানীয়রা ও পর্যটকরা। হকনগর (বাঁশতলা) মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ দোয়রাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের সীমান্তে অবস্থিত। শীত, বসন্ত ও শরৎ এখানে ঘুরতে আসার মোক্ষম সময়।


এইচএইচ/আরআর-০১