সিলেটে দামের ঘোড়া লাগামহীন

বেলাল আহমেদ


অক্টোবর ২০, ২০২১
১২:১৬ পূর্বাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০২১
০২:৩২ পূর্বাহ্ন



সিলেটে দামের ঘোড়া লাগামহীন

রায়হান আহমদ চৌধুরী বেসরকারি ব্যংকের কর্মকর্তা। সিলেট নগরের আম্বরখানার বাজারে এসেছেন মাছ-সবজি কিনতে। বাজারে ঢুকেই ত্যক্ত-বিরক্ত তিনি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে তার এ বিরক্তি। ‘দ্রব্যমূল্য কেন বাড়ছে? এসব দেখার কেউ নেই? কে টানবে দামের পাগলা ঘোড়ার লাগাম?’ এমন অসংখ্য প্রশ্ন ও অভিযোগ তার। আর গৃহকর্মী সালেহা বেগমের ক্ষোভের আগুন যেন দব্যমূল্যের আগুনকেও হার মানায়। তার ভাষ্য ‘আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের ঠাঁই নেই বাজারে।’ তার প্রশ্ন- ‘গেল একমাসে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তাও কেজিতে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত! আমরা কেমনে চলি?’

চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনি, আটা, ময়দা, মুরগি, ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংসার চালাতে। দাম বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে রান্নার গ্যাস, সাবান ও টুথপেস্টের মতো নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীও। বেড়েছে শিশু খাদ্যের দাম। বাদ যায়নি আচার চকলেটের দামও। এভাবে ‘বাজারে আগুনের’ কারণে সংসারের বাজারের ঝুলি দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। 

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এক মাসে প্রায় ১৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। এক মাসের ভেতর দ্রব্যমূল্য এতটা বাড়তে আগে কখনও দেখা যায়নি- এমনটাই দাবি ক্রেতাদের। 

সিলেট নগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা চালের দাম ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় ঠেকলেও পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের ঝাঁঝ যেন কমছেই না। আর দামের তাওয়ায় তপ্ত ডিমের বাজারও। বোতলজাত তেলের দাম গত কয়েকদিন ধরেই উর্ধ্বমুখি। ব্যবসায়ীরা বলছেন তেলের দাম এখনই কমার কোনো সম্ভাবনা নেই, বরং বাড়তে পারে আরও। আর মাছ, মাংসতো পাতেই তুলতে পরছেন না নিম্ন আয়ের মানুষ। এমন বাজার দরে রায়হান কিংবা সালেহাদের মতো সাধারণ মানুষেরও ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। 

ক্রেতাদের অভিযোগ, প্রতিদিনই ভোগ্য পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কোথাও কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পূর্ব কোনো ঘোষণা ছাড়াই অতিজরুরি নিত্য পণ্যের দাম বাড়ে। অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনায় কারও কোনো নজরদারি নেই। ফলে পণ্যের উর্ধ্বমূখি মূল্যের আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষ। 

বাজার ঘুরে জানা যায়, গত এক মাস ধরেই পাইকারি বাজারে সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম উর্ধ্বমূখি। গত সপ্তাহে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১৪৮-১৫৩ টাকা। এ সপ্তাহে তা বেড়ে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৫৮ টাকা। তাছাড়া পাইকারিতে প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকা। 

 এদিকে করোনাকালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেই আবারও বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম। এবার বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলে লিটারে ৭ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গত রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এই প্রস্তাব করা হয়। নিত্যপণ্যের মজুত পরিস্থিতি, আমদানি ও দাম নির্ধারণ নিয়ে বৈঠকটি হয় এদিন। এতে অংশ নেন ভোজ্যতেল উৎপাদন ও বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা। 

এখন প্রস্তাবটিতে বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিবের অনুমোদন সাপেক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। বর্তমানে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৫৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, ৭ টাকা বাড়লে ১৬০ টাকায় পৌঁছাবে। 

এ ছাড়া খোলা সয়াবিনের লিটার ১৩৬ টাকা এবং পামওয়েল তেলের লিটার ১১৯ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে সভায়। বর্তমানে খোলা সয়াবিন ১২৯ টাকা আর পাম তেল ১১৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দাম বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

গতকাল সোমবার বিকেলে নগরের আম্বরখানা, লালবাজার ও ব্রহ্মময়ী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। গত সপ্তাহের তুলনায় প্রতিটি সবজি কেজিতে ৫ থেকে ১০টাকা বেড়েছে। আর ১৫ দিনের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্যের মূল্য বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। বাজারভেদেও আছে দামের তারতম্য। ব্রহ্মময়ী বাজারে যে সবজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, সেই সবজি আম্বরখানা ও লালবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। 

নগরের সোবাহানিঘাট পাইকারি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি মূল্যে বেগুন ২৫ থেকে ২৭ টাকা, বরবটি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ভেন্ডি ৩০ থেকে ৩২ টাকা, শসা ২৮ থেকে ৩০ টাকা, করলা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, সিম ৮০ থেকে ৯০ টাকা, গাজর ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, বেগুন ২৫ থেকে ২৬ টাকা, ফুলকপি ৫৫ থেকে ৬০টাকা, বাঁধাকপি ২৮ থেকে ৩০ টাকা, লাউ ৩২ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। 

সোবাহানিঘাটের পাইকারি বিক্রেতা জয়গুরু ট্রেডার্সের কর্মচারী মো. দুলাল মিয়া বলেন, এখনও মৌসুমী সবজি বাজারে আসেনি। তাই একটু দাম বাড়তির দিকে। তবে মৌসুমী সবজি বাজারে এলেই দাম কমবে। মৌসুমী সবজি বাজারে আসতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে বলেও জানান তিনি। 

এদিকে, খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লালবাজার ও আম্বরখানায় বরবটি ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, আর ব্রহ্মময়ী বাজারে সেই বরবটির দাম ৫০ টাকা। একই অবস্থা অন্য পণ্যগুলোর দামের ক্ষেত্রেও। বেগুন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, ভেন্ডি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, শসা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, করলা ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, সিম ১১০ থেকে ১২০ টাকা, গাজর ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, ফুলকপি ১০০ থেকে ১১০ টাকা, বাঁধাকপি ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা, লাউ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। 

চিনির দাম কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চিনি এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৮ টাকা দরে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ৮২ টাকা। আর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।   

৪০ টাকার কমে এক হালি ডিম মিলছে না। গত সপ্তাহে দাম ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা।  আর সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ছাড়িয়েছে ১৫০ টাকা, গত সপ্তাহে যার মূল্য ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। খুচরা বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়; যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আর ছোট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে। গত সপ্তাহে যে চাল বিক্রি হয়েছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। 

নগরের মাছ ও মাংসের বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, হাড়সহ গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকায়, গত সপ্তাহে যা বিক্রি হয়েছিল ৫৬০ থেকে ৫৮০ টাকায়। হাড় ছাড়া মাংস গত সপ্তাহে ছিল ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়। আর খাসির মাংসের দাম হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে। প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে ১১০০ টাকায়। গতসপ্তাহে খাসির মাংস বিক্রি হয়েছিল ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায়। 

কাতলের দাম ওজনভেদে ৩০ টাকা বেড়ে এখন হয়েছে ২১০ থেকে ২৭০ টাকা। ৩ কেজির সিলভার কার্প এখন ৩০০ ও দেড় কেজির মাছটি ১৮০ টাকা। আর রুই মাছ আকারভেদে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২৬০ থেকে ৩২০ টাকায় যা গত সপ্তাহে ছিল ২৩০ থেকে ৩০০ টাকা। ২ কেজির পাঙ্গাশ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায় যা গত সপ্তাহে ছিল ১৮০ থেকে ২০০টাকা। আর ছোট কাচকি মাছ ৩০০ টাকা, চাপিলা ২০০ টাকা, দেশি ট্যাংরা ৩৬০ টাকা, বড় চিংড়ি ৭৫০ টাকা ও শিং ৪০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। 

নগরের লালবাজারে কথা হয় রিকশাচালক মফিজ মিয়ার সঙ্গে। নগরের একটি বস্তিতে স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে মফিজ মিয়ার সংসার। সন্তানদের পড়ালেখার খরচের পাশাপাশি সংসারের খরচ সবই চলে তার একক আয়ে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজার ঢুকতেই হিমসিম খেতে হয় থাকে। তিনি বলেন, ‘সব কিছুর দাম বেশি। যে জিনিসেরই দাম জিজ্ঞেস করি তারই দাম চড়া। গত একমাসের মধ্যে মাছ-মাংস পাতেই তুলতে পারিনি। আর যে ডাল, সবজি ও ডিমে আমাদের মতো গরিব মানুষের ভরসা সেই জিনিসগুলোও এখন আর কিনতে সাহস পাই না।’

চাকরিজীবী মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সব কিছুর এত বেশি দাম হলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষরা কী খাবে? ব্রয়লার মুরগি খেয়ে মাংস খাওয়ার স্বাদ ভুলে থাকি কোনো রকমে। কিন্তু সেই ব্রয়লার মুরগির দামও ১৭০ টাকা কেজি। প্রতিটি জিনিসের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখে অর্ধেক ব্যাগ বাজার করেই ফিরতে হচ্ছে। বেশি বাজারের ইচ্ছে থাকলেও অতিরিক্ত দামের কারণে তুলনামূলক কম জিনিস নিয়েই ফিরছি।’

আর রাজ্যের হতাশা ঘৃহিণী তাসনিম আক্তারের চোখে-মুখে। তিনি বলেন, ‘বাজারে এলেই হতাশ হতে হয়। সব কিছুর এত চড়া দাম মনমতো কিছুই কেনা যায় না। শখ করে কিছু খেতে চাইলেও অতিরিক্ত দামের কারণে কেনা হয়ে ওঠে না।’

স্কুল শিক্ষক মুহম্মদ ইমদাদ বলেন, ‘বাজারে চাল ডাল তেলসহ দ্রব্যমূল্য বাড়ছেই। লাগামছাড়া দামে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। গরিব মানুষের সস্তায় ক্রয়ের শেষ পণ্য মোটা চালের কেজি পৌঁছেছে ৫০ টাকায়। চালের দামের ওপর নির্ভর করছে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামের সমীকরণ। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে না সারাদেশে কালোবাজারি ঠেকানোর কার্যক্রম। অধিকন্তু বছরের এই সময়ে বাংলাদেশে চালের দাম বৃদ্ধি নজিরবিহীন এবং উৎকণ্ঠার।’ 

তবে বাজারের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট জেলার সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত বাজার মনিটরিং আছে। আসলে আমরা বাজারের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। যা করতে পারি তা হলো- ধরেন একটি পণ্য কালিঘাটে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সেই পণ্যটি যেন মদিনা মার্কেট বা টিলাগড়ে ৭০-৭৫ টাকায় কেউ বিক্রি করতে না পারে। সেটি যেন ৬১-৬২ টাকার মধ্যে থাকে। যদি দেখি কেউ নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে আমরা তখন ওই ব্যবসায়ীকে শাস্তি দিয়ে থাকি।’

আরসি-১৫