সিসিকের কুড়ালের কোপে সাড়ে ৩’শ গাছ উজাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক


অক্টোবর ২০, ২০২১
০৫:৩১ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২০, ২০২১
০৫:৩১ অপরাহ্ন



সিসিকের কুড়ালের কোপে সাড়ে ৩’শ গাছ উজাড়
# নেওয়া হয়নি বন বিভাগের অনুমতি

সিলেট নগরের শাহজালাল উপশহরের রাস্তার দুইপাশের প্রায় তিন দশক বয়সী বৃক্ষে পড়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের কুড়ালের কোপ। সড়ক সম্প্রসারণ আর ড্রেন নির্মাণের অজুহাতে কাটা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ গাছ। গত কয়েকদিন ধরে গাছ কাটা চললেও গত সোমবার এক রাতে একসঙ্গে শতাধিক গাছ কাটা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। উপশহরের গাছ কাটার জন্য বন বিভাগের অনুমতির জন্য সিসিকের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হলেও বন বিভাগের অনুমতি পাওয়ার আগেই তাড়াহুড়ো করে গাছ উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। এসব গাছের আনুমানিক মূল্য দুই কোটি টাকার কাছাকাছি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সোমবার রাতের আধারে একসঙ্গে শতাধিক গাছ কাটা হলেও সিটি করপোরেশন প্রায় ১০-১৫ দিন ধরে গাছ কাটছে। উপশহরের বিভিন্ন বøকের রাস্তার দুইপাশের গাছ কাটা হলেও সেগুলো আলাদাভাবে নজর কাড়েনি কারও। কিন্তু এসব বøকের শতাধিক গাছ এরই মধ্যে কেটে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার উপশহর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উপশহরের প্রধান সড়ক আশেপাশে বিপুল সংখ্যক গাছ নির্বিচারে কাটার পর সেগুলোকে ফালি করে রাস্তার পাশেই ফেলে রাখা হয়েছে। কিছু গাছের ফালি ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গাছ সরানোর কাছে ব্যবহৃত ট্রাকগুলোও সিটি করপোরেশনের নয় বলে জানা গেছে। সেখানে কর্মরত সিটি করপোরেশনের কর্মচারী ও ট্রাক চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ২০০ গাছ কাটা হয়েছে। তার মধ্যে ২১৭টি বড় আকারের পরিপক্ক গাছ। তবে উপশহরের বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন প্রায় সাড়ে ৩০০ গাছ কাটা হয়েছে গত ১০ থেকে ১২ দিনে।

উপশহরের বাসিন্দা বৃক্ষপ্রেমী আফতাব চৌধুরী বলেন, ‘সিটি করপোরেশন উন্নয়ন কাজের নামে উপশহর এলাকার অন্তত সাড়ে ৩০০ গাছ কেটে ফেলেছে। যেখানে দুটি গাছ কাটলে হয় সেখানে তারা ১০ থেকে ১৫টি গাছ কেটেছে।’ গাছগুলোকে রক্ষায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতদিন তারা বিভিন্ন বøকে গাছ কেটেছে। শুরুর দিকে ‘এ’ বøকে শতাধিক গাছ কেটেছে। এরপর বি, সি ও ডি বøকে কমপক্ষে আরো ১৫০টি গাছ কেটেছে। গতরাতে মূল সড়কের অন্তত ১০০ গাছ কেটে ফেলেছে।’ সুবহানীঘাট হয়ে উপশহরের প্রবেশমুখ থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত সড়কে নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে বলে তিনি জানান।’

১৯৯০ সাল থেকে উপশহর এলাকার রাস্তাগুলোর দুই পাশে নিজে উদ্যোগী হয়ে বৃক্ষরোপন করেন আফতাব চৌধুরী। এ উদ্যোগের জন্য ১৯৯৮ সালে তিনি বৃক্ষরোপনে জাতীয় পুরস্কার পান। নিজের হাতে লাগানো বৃক্ষগুলোর নির্বিচারে নিধনযজ্ঞ দেখে মর্মাহত এই বৃক্ষপ্রেমী। তিনি বলেন, ‘আমি রীতিমতো অসুস্থবোধ করছি। এমন নির্দয় দৃশ্য চোখে পড়বে বলে বাসা থেকে বেরুচ্ছি না। সিটি করপোরেশন গাছ কেটে পুরো উপশহরকে রীতিমতো ন্যাড়া বানিয়ে ফেলেছে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার চাই আমি।’

বন বিভাগের বিধিমালা অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন কিংবা সরকারি জমির গাছ কাটার আগে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কাছে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। এরপর তদন্ত করে গাছ টাকার যৌক্তিকতা পাওয়া গেলে গাছের দরদাম নির্ধারণ ও পরবর্তীতে আরও গাছ লাগানোর শর্তে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়া বন বিভাগের মাধ্যমে করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

ভ‚মিসন্তান বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক আশরাফুল কবির সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমরা গাছকে প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু অনেকের কাছে তা শুধুই টাকা। গাছ কাটলেও টাকা, বিক্রি করলেও টাকা। নির্বিচারে গাছ কেটে আমরা প্রকৃতির যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছি তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ সুখকর হবে না। প্রকৃতিবিনাশী সব কর্মকান্ড পরিহার করতে হবে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া যদি গাছ কাটা হয়ে থাকে তাহলে বন বিভাগ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর আগেও এমন ঘটনায় তাদের কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।’

বন বিভাগের সিলেট টাউন রেঞ্জার মো. শহীদুল্লাহ বিধিমালার কথা জানিয়ে বলেন, ‘উপশহরে রাস্তার দুই পাশে ড্রেন নির্মাণ কাজের জন্য গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে ১৭ অক্টোবর বন বিভাগে চিঠি দেয় সিটি করপোরেশন। আমাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই এলাকায় এখনও গাছের মেজারমেন্ট শেষ হয়নি। আগামীকাল (আজ বুধবার) আবার আমরা যাবো। এরপর আমাদের মতামত জানাব।’ কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩০০ গাছ কাটা হয়ে গেছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা মতামত জানানোর আগে গাছ কাটা হয়ে গেলে সেটা ঠিক হয়নি। তাছাড়া আজকে যখন অভিযোগ শুনেছি। আমরা ওদিকে টহল বাড়াব।’

নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান সিলেট মিররকে বলেন, ‘গাছ কাটার অনুমোদন চেয়ে আমরা বন বিভাগকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু অনুমোদন আসার আগেই ওই কাজের সঙ্গে জড়িত কিছু অতি উৎসাহী লোকজন গাছ কাটা শুরু করেছেন। এটি ঠিক হয়নি। আমাদের লোকজন ভুল করেছে।’ রাতের আঁধারে গাছ কাটা অপরাধ কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ এটা ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টির খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’ কি ব্যবস্থা নেবেন এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘উপশহরে গাছ কাটার বিষয়ে তদন্ত করা হবে। আর যাতে অকারণে কোনো গাছ কাটা না হয়, সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াব।

এএফ/আরসি-০৭