অসাম্প্রদায়িক চেতনার সর্বজনীন উৎসব আজ

সিলেট মিরর ডেস্ক


এপ্রিল ১৪, ২০২২
০৩:২৯ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৪, ২০২২
০৩:২৯ পূর্বাহ্ন



অসাম্প্রদায়িক চেতনার সর্বজনীন উৎসব আজ

'আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন মুক্ত সীমারেখা'- এমন অনুভবই তো জেগে ওঠে আমাদের মধ্যে আজকের এই দিনে; এই পহেলা বৈশাখে। কবি জীবনানন্দ দাশের মগ্ন চৈতন্যে দুলে ওঠা ওই মৃত্যুবিহীন মুক্ত সীমারেখায় আমরা দাঁড়িয়ে থাকি মুক্ত মায়া নিয়ে, মুগ্ধ-হৃদয় চেয়ে। আকাশে-বাতাসে আন্দোলিত হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই আহ্বান, 'তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে'। কালবৈশাখীতেও হৃদয়ে তরঙ্গিত হয় বিদ্রোহী নজরুলের উজ্জ্বল উল্লাস, 'তোরা সব জয়ধ্বনি কর'।

এবার এই নতুন বাংলা সনে, ১৪২৯ বঙ্গাব্দের নতুন সূর্যোদয়ে এসে মিশেছে দেশের মানুষের প্রতিবাদী জাগরণের ঢেউ। নতুন সূর্যোদয়পূর্ব তীব্র ঝঞ্ঝামুখর কয়েকটি সপ্তাহে নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আমরা আবারও অনুভব করেছি, বাংলা নববর্ষ বাধাবন্ধনহীনভাবে উদযাপনের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। সংহতি, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুগভীর লৌকিক আদল নির্মাণের পরও এ দেশের জনগোষ্ঠীগুলোকে লড়াই করতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, অজ্ঞানতা, মৌলবাদিতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতার বিরুদ্ধে। লড়াই করতে হচ্ছে প্রগতির ছদ্মাবরণে থেকে ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অপচেষ্টায় মত্ত শক্তির বিরুদ্ধেও।

পহেলা বৈশাখ লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধ। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীণ জীবন- এ নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে জাতীয়তাবোধে। সারা দেশে এই অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রতিটি বাঙালির শিকড়ের মিলনমেলায়। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। তবে বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়, বাংলাভাষী নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভসূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে জাতি। বর্ণিল উৎসবে মেতে আমন্ত্রণ জানায় প্রাণের উৎসবকে।

পহেলা বৈশাখ- বাংলা সনের প্রথম এই দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশ-বিদেশে বসবাসরত প্রতিটি বাঙালি নববর্ষ হিসেবে পালন করে। সে হিসেবে এটি বাঙালির সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের আমলে বৈশাখে প্রথম বাংলা সনের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন।

উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে শৃঙ্খলা আনতে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন সবাই বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। মূলত বাঙালির এই প্রাণের উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আবহমান বাংলার কৃষি। গ্রামীণ মেলাগুলো পরিণত হয় উৎসবে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার।

মেলাতে থাকে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠাপুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি একসময় প্রচলিত ছিল। এই উৎসবের রং একটি অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে সর্বপ্রথম পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠান আয়োজন হয়। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসা¤প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা; ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

তবে হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবের আনন্দকে ¤øান করে দিতে থেমে নেই মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার দুষ্ট রাহু। বারবার আঘাত হেনেছে। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন। অসাম্প্রদায়িক এই চেতনাকে বিনষ্ট করতে পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে স্বয়ং জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে দেয় দুর্বৃত্তরা। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে কারাগারে কাটাতে হয় ১৯ দিন। শিক্ষক আমোদিনী পালকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হয়, টিপ পরার কারণে হয়রানির শিকার হতে হয় শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দারকে। এর পেছনে মৌলবাদের বিস্তৃতিলাভ, তৃণমূলে ধর্মীয় উগ্রবাদ, বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব, সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, নৈতিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয়তাই দায়ী। আর এই মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক চর্চা বিমুখতার সময়ে বাংলা নববর্ষ হতে পারে সম্মিলিত প্রতিবাদের অহিংস হাতিয়ার। ধর্মান্ধ, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সম্প্রীতির বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে পহেলা বৈশাখ; যার মূলমন্ত্র- বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, আমরা সবাই বাঙালি। জয় হোক বাঙালির। শুভ নববর্ষ।


এএফ/০১