সাংবাদিকেরা যা লিখতে চাচ্ছেন তা লিখতে পারছেন না : সম্পাদক পরিষদ

সিলেট মিরর ডেস্ক


মে ১৪, ২০২২
১০:১৩ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ১৪, ২০২২
১০:১৩ অপরাহ্ন



সাংবাদিকেরা যা লিখতে চাচ্ছেন তা লিখতে পারছেন না : সম্পাদক পরিষদ

দেশে দিনদিন মুক্ত সাংবাদিকতার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ স্বাধীন সাংবাদিকতাবিরোধী বিভিন্ন আইনের কারণে সাংবাদিকেরা যা বলতে চান তা বলতে পারছেন না, যা লিখতে চাচ্ছেন তা লিখতে পারছেন না। যার কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২ তম অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। বারবার গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও দেশে মুক্ত গণমাধ্যম চর্চা করতে দেওয়া হচ্ছে না। গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্র বিকাশ হবে না।

আজ শনিবার (১৪ মে) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস: ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এত আইন কেন তা জানতে চান। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আপনাদের পেশা বিকশিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আইনটির ১৪টি জায়গা জামিন অযোগ্য রয়েছে। সাংবাদিকতা কি এইরকম অপরাধ যে—এটা জামিন অযোগ্য হবে। ডিজিটাল অপরাধের বিরুদ্ধে এটার প্রয়োগ হওয়ার কথা থাকলে এটা এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হচ্ছে। এটা গণমাধ্যমের ওপর প্রয়োগ হবে না তা আইনে থাকলেই আমাদের দাবিটা বাস্তবায়ন হয়ে যায়।’

মাহ্‌ফুজ আনাম আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে না। তাই গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্র ব্যাহত করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। তাও আমরা সাংবাদিকতা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা গণমাধ্যম বিকশিত হওয়ার জন্য যা যা দরকার করে যাব।’

সভায় আজকের পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি, এদিকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা সেভাবে স্বীকার করি না। একটা পরস্পর বিরোধী অবস্থানে চলে যাই। আমরা দেখেছি যে, এ পর্যন্ত যত সরকারই এসেছে তারা কেউ সেভাবে প্রেস কিংবা গণমাধ্যমকে সহায়তা করার জন্য একেবারে আত্মনিয়োগ করেছে, সে কথা বলা যাবে না। কারণ প্রত্যেকটা সরকারই গণমাধ্যমগুলোকে একটা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি মনে করে। এই জায়গাটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেখানে আমরা গণতন্ত্রের চর্চার কথা বলছি, গণতন্ত্রের সংস্কৃতির কথা বলছি কিন্তু সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে পারছি না। এই যে স্ববিরোধিতা, এই জায়গাটায় সাংস্কৃতিক যে প্রক্রিয়া সেটার সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটটা চিহ্নিত করা দরকার।’

অধ্যাপক গোলাম রহমান আরও বলেন, ‘এগুলো নিয়ে শুধু সুশীল সমাজ কথা বলছেন। কিন্তু আমি বলব শুধু সুশীল সমাজ নয় এখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আনতে হবে। গণতান্ত্রিক চর্চায় প্রকৃতপক্ষে তাদের অংশগ্রহণ করা জরুরি। আমার মনে হয় সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এ সমাজের নাগরিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে নিশ্চয়ই, অবশ্যই গণমাধ্যমরে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।’

আজকের পত্রিকার সম্পাদক আরও বলেন, ‘ডিজিটাল টেকনোলজির কারণে জনগণ বা নাগরিকের যে সুবিধাটা পাওয়ার কথা সেটা যদি নিশ্চিত করতে হয় তাহলে এটাকে আইনি সহায়তা দিতে হবে। কিন্তু আমরা এই আইনি সহায়তার নাম করে যখন আইন প্রণয়ন করতে দেখি, আর সেই আইন জনগণের বিরুদ্ধে চলে যায়, তখন সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এবং চ্যালেঞ্জটাকে চিহ্নিত করে অন্তত বর্তমান কাজগুলোর পরিকল্পনা করি।’

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘দেশে সাংবাদিকতা আইনগতভাবে নজরদারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এটাকে আরও শক্ত করা হয়েছে। সার্বিকভাবে এই আইনের মাধ্যমে আমাদের কথা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন আছে কিন্তু তা হবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অপরাধ রোধের জন্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের যে ধারাগুলো বাধা সৃষ্টি করে সেগুলো বাদ দিতে হবে।’

ডিইউজের একাংশের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কোনো আইন হতে পারে না। আইন হয় মানুষ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অথচ এই আইন রাষ্ট্রকে পিছিয়ে দিচ্ছে। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা যেই আইন কেড়ে নেয় সেটা আইন হতে পারে না। এই কালো আইন বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর সময় বলা হয়নি ‘ভাত দে হারামজাদা?’ —তাই বলে মেরে ফেলেছে? নেতাদের সমালোচনা করা যায় কিন্তু জানোয়ারের সমালোচনা করা যায় না। যারা সমালোচনায় বাধা দেন তাঁরা কি তাদের জানোয়ারদের কাতারে নিয়ে যাচ্ছেন?’

বিএফইউজে সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও সাংবাদিকদের মোবাইল ট্র্যাকিং করে সাংবাদিকদের নজরদারিতে রাখা হয়। গত ১৩ বছরে ৪৫ জন সংবাদকর্মী খুন হয়েছেন। ২০০৯ সালের গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১২১ থেকে ১৬২ তম হয়েছি। নিউ মার্কেটে সহিংসতায় ১৪ জন সাংবাদিক আহত হয়েছে। অথচ মামলা হলেও সাংবাদিকদের আহত হওয়ার ঘটনায় একটা জিডিও হয়নি।’

বিএফইউজে এর একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, ‘সাংবাদিকেরা সরকার কেন মালিকের আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে কথা বললেও চাকরি চলে যায়। নজরদারি শুধু আমাদের ওপর সরকার না, আমাদের মালিকেরাও করছে।’

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আইনটি পাসের সময় বলেছেন এই আইন তাঁর স্বপ্ন ছিল। তাঁর স্বপ্নের জন্য তো আর সাংবাদিকতার বারোটা বাজতে পারে না। তার পর থেকেই এই আইন অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এই আইনের অধীনে ৮৭ ভাগ মামলায় কোনো সাজা দেওয়া হয় নাই। অর্থাৎ এটা হয়রানি করার জন্য করা হয়েছে।’

সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও মানবজমিনের সম্পাদক বলেন, ‘এরশাদ, খালেদা জিয়ার আমলে জেলে গিয়েছিলাম। এই সরকারের আমলে ৮ মাস বাইরে থেকেছি। মালিকদের মধ্যে সমস্যা নাই, আমাদের মধ্যেই সমস্যা। কোনো লেখা আসলে সাংবাদিকরাই বলে এই লেখাটা না দিলে কেমন হয়? আমরা যা দেখছি তা দেখছি না, যা বলছি তা বলছি না, যা শুনছি তা শুনছি না। আমরা দেখি, শুনি কিন্তু কার্যকর করি না। প্রতিদিন আমি ভয় পাই। বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। এই যে ভয়, এটা থেকে মুক্তির জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।’

সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘ডিজিটাল নজরদারিতে কি সাংবাদিকতা করা যায়? এটাকে কি মুক্ত সাংবাদিকতা বলা যাবে? আমরা লিখতে পারি কিন্তু যেটা লিখতে চাই সেটা পারি কিনা? ডিজিটাল অবরোধের যুগে সাংবাদিকতা যদি করতে চাই তাহলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’

দ্য নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক ও পরিষদের সহসভাপতি নূরুল কবির বলেন, ‘সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিলেও কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার সব সময় গণমাধ্যমকে দমন করতে চায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার উন্নয়নের জন্য হওয়ার কথা থাকলেও সেটা এখন মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

অনুষ্ঠানে নোয়াবের সভাপতি এ. কে আজাদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। নোয়াব এটার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই কথা বলেছে। সংবাদপত্রের বিকাশে সাহসী নেতৃত্ব দরকার। তবে এখন সেটা কমে আসছে। আয় না থাকলে সংবাদপত্র বিকাশ হয় না তাই পত্রিকার আয় বৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। সরকারি বিজ্ঞাপনের ১২০০ কোটি টাকা আমরা এখনো পাওনা আছি।’

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

বিএ-০৩