সিলেট মিরর ডেস্ক
ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
০৭:১৬ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২৩
০১:০২ পূর্বাহ্ন
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আল-দানায় ভূমিকম্পের মুহূর্তের পরিস্থিতি ছিল একেবারে বিপর্যয়কর
ইসমাইল আলরিজ। তার ছয় বছরের ছেলে মুস্তফাকে হাসপাতালে রেখে মাত্রই বের হয়েছেন। আর তখনই হিংস্র কম্পন শুরু হয়। ভবনটি ভেঙে পড়তে দেখে সেই সময় ইসমাইল কেবল সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতে শুরু করেন।
হোয়াটসঅ্যাপে বিবিসির প্রতিনিধি লিনা শাইখোউনিকে তিনি বলেন, তারপর ভূমিকম্পটি আরও তীব্র হয়ে উঠল। এর পরপরই বিদ্যুৎ চলে গেল। গ্লাসের তৈরি হাসপাতালের প্রবেশদ্বার মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।
ইসমাইল বলেন, ‘এটা একেবারে কেয়ামতের দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছিল। আমি ধ্বংসস্তূপ থেকে আমার ছেলেকে কীভাবে উদ্ধার করতে পারবো, কেবল সেই চিন্তা করতে শুরু করলাম।’
এক মিনিট পর মুস্তফা হাসপাতালের ভেতরে তার ছেলের কাছে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। গিয়ে দেখেন ছেলে চিৎকার করে কান্না করছে। সে তার হাতের স্যালাইনের লাইন খুলে ফেলেছে। তার হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
ইসমাইল কেবল তার ছেলেকেই উদ্ধার করেননি, বরং আতঙ্ক আর অন্ধকারের মাঝে অন্যদের হাসপাতাল থেকে চলে যেতে সহায়তাও করেন। বাড়িতে স্ত্রী এবং অন্য সন্তানরা কেমন আছে, তা জানতে ছুটে চলার আগে নিজের গাড়িতে তিনি কয়েকজন নার্স ও একজন গর্ভবতী নারীকে জায়গা দেন তিনি। সেখানে ওই নারী এক সন্তানের জন্ম দেন।
পরে সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে স্ত্রী ও অন্য সন্তানদের নিরাপদ দেখতে পান তিনি। ইসমাইলের বাড়িটিও অক্ষত আছে। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আল-দানায় ভূমিকম্পের মুহূর্তের পরিস্থিতি ছিল ঠিক এমন বিপর্যয়কর। ইসমাইল দুটি আবাসিক ভবন ধসে পড়তে দেখেছিলেন। কিন্তু বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় তিনি উদ্ধারকারীদের ফোন করতে পারেননি। ধসে পড়া ভবন থেকে লোকজনকে উদ্ধারের জন্য লোকজন পৌঁছায় এর ঠিক এক ঘণ্টা পর।
তুরস্কের সীমান্তবর্তী ইদলিব প্রদেশের বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত একটি শহর আল-দানা। দামেস্কের সরকারের যেকোনও পরিষেবার অনুপস্থিতিতে বিদ্রোহীদের পরিচালিত সিভিল ডিফেন্সের শাখাগুলোই জরুরি মুহূর্তে কেবল সাড়া দেয়। কিন্তু ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে, সেখানে সিভিল ডিফেন্সের তৎপরতায় প্রত্যেকের কাছে পৌঁছানো একেবারে অসম্ভব।
সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৮ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার কয়েক ঘণ্টা পর ইসমাইল পরিস্থিতি দেখার জন্য আশপাশের এলাকায় যান। পেশায় সাংবাদিক সিরিয়ার এই নাগরিক বলেন, অবর্ণনীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কয়েক বছরের যুদ্ধে সিরিয়ার সরকার কিংবা রুশ বাহিনী যেসব শহরে বোমাবর্ষণ করেছিল, সেসব শহরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২০১১ সালে রাশিয়ার সমর্থনে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা শুরু করার পর থেকে দেশটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয়। তবে গত তিন বছরে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি চলছে। এই এলাকাটি সিরিয়ার বিদ্রোহীগোষ্ঠী বা দামেস্ক-ভিত্তিক সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিভক্ত।
দেশটির সরকার নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পোর উত্তরে আতারেব শহরে কয়েক ডজন আবাসিক ভবন ধ্বংস হতে দেখেছেন ইসমাইল। তিনি বলেন, আশপাশের এলাকায় এমন অনেক ভবন রয়েছে, যেখানে সরঞ্জামের অভাবের কারণে উদ্ধারকারী দল পৌঁছাতে পারছে না। আমাদের আসলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা দরকার।
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমজুড়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভূমিকম্পে আহতদের চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে সিরিয়ান আমেরিকান মেডিকেল সোসাইটি (সামস) নামের একটি সংস্থা। আতারেবের সামস হাসপাতালে কাজ করছেন চিকিৎসক ওসামা সাল্লুম। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের প্রথম কয়েক মুহূর্তে কী ঘটছে তা বুঝতে পারছিলেন না তিনি।
সাল্লুম বলেন, আমি ভেবেছিলাম, মৃত্যু একেবারে কাছাকাছি। আমি অনেক ভবন এবং পাথর পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার সময় সেখানে প্রায় ৫৩ জনের মৃত্যুর তথ্য পান বলে জানিয়েছেন এই চিকিৎসক। তবে পরবর্তীতে সেই সংখ্যা ১২০ জনের বেশি হয়।
‘আমি আহতদের সংখ্যা হিসাব করতে পারিনি,’ যোগ করেন তিনি।
দেশটির সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তরাঞ্চলেও ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ভূমিকম্পের সময় উপকূলীয় শহর লাতাকিয়ায় নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে ছিলেন আয়া। ২৬ বছর বয়সী এই পাচক বলেন, ওই সময় তার মা এবং তিন ভাইবোনের সাথে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়।
‘আমি বিছানা থেকে উঠেছিলাম। কিন্তু আমি কী কারণে জেগে উঠেছিলাম তা সেই মুহূর্তে নিশ্চিত ছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আসলে কী ঘটছে। পরে পরিবারের বাকি সদস্যদের খুঁজে পাওয়ার পর ভূমিকম্পের বিষয়টি বুঝতে পারি।’
লাতাকিয়ার প্রধান একটি সড়কের পাশেই তাদের বাড়ি। এখন এই সড়কের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানালার গ্লাস ও ভবনের ধ্বংসাবশেষ।
আয়া বলেন, ‘ভূমিকম্পের তীব্রতার কারণে আমরা নড়াচড়া করতে পারিনি। আমরা ঘটনাস্থলেই থেকে যাই।’ তার মা পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত। সেই সময় তিনি ভয় পান এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
এই তরুণী বলেন, আমি একেবারে থমকে যাই। নড়াচড়া করতেও পারছিলাম না। দেয়াল কীভাবে কাঁপছে এবং পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে, কেবল তা-ই দেখতে থাকলাম। পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ ছিল তা আমি বর্ণনা করতে পারব না।
এএফ/০৫