সিলেট মিরর ডেস্ক
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩
০৬:০১ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩
০৬:০১ পূর্বাহ্ন
তুরস্কের গাজিয়ান্তেপের প্রবাসী নাসিম বানু। মেয়ে রোহিনী রাহার পড়ালেখার কারণে গত ৩ বছর ধরে সেখানে আছেন তিনি। উর্বর উঁচু-নিচু টিলাপাহাড় নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটি যে একদিন মৃত্যুপুরীতে রূপ নেবে তা অন্য সবার মতো তিনিও কখনো ভাবতে পারেননি।
গত এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে মারাত্মক এই ভূমিকম্পের সাক্ষী নাসিম বানু। বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনা জানান তিনি।
ভূমিকম্পের রাতের কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, সোমবার রাতে যখন প্রথম ভূমিকম্প আঘাত হানে তখন আমি, আমার মেয়ে আর মেয়ের এক বান্ধবী বাসায় ছিলাম। আমি আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মেয়েরা রাত জেগে পড়াশোনা করছিল। হঠাৎ মেয়ের চিৎকার শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি পুরো ভবন ডান দিন থেকে বাম দিকে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল আজ এখানেই মারা যাবো। ভূমিকম্পের বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকার কারণে ওই সময় আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে যাওয়ার চেষ্টা না করে সবাই ডাইনিং টেবিলের নিচে আশ্রয় নিলাম। দেড় মিনিট ধরে ভূমিকম্প চলার পর যখন কিছুটা সময়ের জন্য থামে তখন আমরা যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় শুধু গায়ে ওভার কোট আর পায়ে স্নো বুটটা পড়ে নিচে নামি। নিচে নেমে দেখি হাজার হাজার মানুষ। তারা সবাই একটু আশ্রয়ের আশায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। পরে আমরা কয়েকজন মিলে মেইন রোডের দিকে গেলাম।
নাসিম বানু বলেন, মেইন রোডে গিয়ে দেখি একটি পেট্রোল পাম্পে সবাই আশ্রয় নিয়েছে আর সেখানে যে যা পাচ্ছেন কিনে নিচ্ছেন। কেননা আমরা তখন জানতাম না আমাদের ভবিষ্যৎ কী। অন্য সবার দেখাদেখি আমরাও কিছু খাবার কিনে নিলাম। আমরা যখন রাস্তায় ছিলাম সে সময়ও আফটার শক হচ্ছিল। পরে যখন অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে এলো তখন রাত ১২টার দিকে আমরা আবার বাসায় ফিরি। বাসায় ফেরার পর মেয়ে নেট দেখে জানায় রাত সাড়ে ১২টার পর নাকি আরও একটা ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা আছে এবং ওই মেসেজে আমাদের নিকটবর্তী কোনো মসজিদ বা জিমনেশিয়ামে আশ্রয় নিতে বলেছে। আমরা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে যেতেই আবার শুরু হয় ভূমিকম্প। এবারের কম্পনও ছিল আগেরটির মতোই। পরে আমরা বাসার কাছের একটি মসজিদে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। পরে সেখানে কিছু সময় থেকে আবার রাস্তায় আসি।
তিনি বলেন, অন্যান্য দিনের চেয়ে সেদিন অনেক বেশি ঠান্ডা ছিল। বাইরে আমরা কোনোভাবেই টিকতে পারছিলাম না। আবার কোনো ভবনেও আশ্রয় নেওয়ার মতো সাহস পাচ্ছিলাম না। কেননা তখনও আফটার শক হচ্ছিল। পরে আমরা রাস্তার পাশে কাঠের ছাদের তৈরি একটি ক্যাফে দেখতে পাই। সেখানে আমরা কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নিই ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য। কেননা আমার মাথায় তখন এইটুকু চিন্তা হচ্ছিল যে কোনো ভবনের নিচে আশ্রয় নিলে সেটা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। আর কাঠের ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে ছাদ ভেঙে পড়লেও আমরা মারা যাবো না। তবে ঠান্ডার হাত থেকে রেহায় পাবো। সেখানে আমরা রাত সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ছিলাম। সে সময় দেখি একদল মানুষ গাজিয়ান্তেপের মেডিকেল ইউনিভার্সিটির দিকে যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে না কি সেখানে শেল্টার খোলা হয়েছে। পরে আমরা সেখানে গিয়ে দেখি সেটি আলরেডি ভরে গিয়েছে। পরে আমদের আরেকটি নতুন শেল্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা বর্তমানে এখানেই আছি
নাসিম বানু বলেন, এই রাতের কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। কারণ আমরা বাংলাদেশিরা সাধারণত কয়েক সেকেন্ডের ভূমিকম্পে অভ্যস্ত এমন অনবরত কম্পনের সঙ্গে মোটেও পরিচিত না। ধ্বংস স্তূপ দেখে আমার বার বার 'রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি'র কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
উল্লেখ্য, তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত নিহত ১৯ হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। তুরস্কে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ১৭০ জনে।আর সিরিয়ায় নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে তিন হাজার ১৬২ জন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের শিকার হয়েছেন বলে ধারণা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এতে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।
এএফ/০৩